রাবি ছাত্রনেতাদের ভাবনায়, ছাত্র রাজনীতি

রাবি প্রতিনিধি: চাঁদাবাজির অভিযোগে সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। আবার কিছুদিন ঘটে যাওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ কে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সহ ১৫জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

এ হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেছে বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এদিকে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে অনেকেই। আবার গত বুধবার গণভবনে সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বুয়েটে পিটিয়ে ছাত্র হত্যা এবং ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বুয়েট কর্তৃপক্ষ চাইলে তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে পারে, আমরা হস্তক্ষেপ করবো না কিন্তু ছাত্র রাজনীতি কেন বন্ধ করা হবে?’’

এখন বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনগুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আগে ও পরবর্তী সময়ে নানা সংকটের মুহূর্তে জনমুখী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার ইতিহাস রয়েছে এসব সংগঠনের। তবে সেই অতীত ইতিহাস ছাপিয়ে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়তেই থাকছে।

এসব নিয়ে কথা বলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রনেতা। আব্দুল মজিদ অন্তর। আহবায়ক, রাকসু আন্দেলন মঞ্চ। এহসান মাহফুজ। সহ-সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। সুলতান আহমেদ রাহী। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। রিদম শাহরিয়ার। আহবায়ক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আব্দুল মজিদ অন্তর:

আবাসিক হলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা, খাওয়া আর নির্ভয়ে ঘুমানোর নিশ্চয়তা চায়, যখন হলে হলে এবং রুমের ভিতর রাজনীতি প্রবেশ করে তখন তার এই নিশ্চয়তা থাকে না। প্রতিটি হলে হলে ছাত্রলীগ পলিটিকাল ব্লক গড়ে তুলে দখলদারিত্ব কায়েম করে রেখেছে। কার্যত হল প্রশাসনের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব এবং আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগ আবাসিক হলগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সিট বাণিজ্য আর নির্যাতনের আখড়ায় পরিনত করেছে।

প্রতিটি সাধারণ শিক্ষার্থীর কাছে হল একটি আতঙ্কের নামে পরিনত হয়েছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে রাজনীতি নেতিবাচক হিসেবে প্রতিয়মান হয়। আমরা প্রায় শিক্ষার্থীদের কাছে শুনে থাকি ‘আই হেইট পলিটিক্স। এটাকে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ মনে করে থাকেন যারা পলিটিক্স সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না, তারাই আই হেইট পলিটিক্স বলে থাকেন।

আমি মনে করি বর্তমান প্রজন্ম চোখের সামনে যে রাজনীতি দেখছেন তাকে কোনোভাবেই পছন্দ করার মত নয়, ছাত্র রাজনীতি যদি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হতো, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে হতো তাহলে শিক্ষার্থীরা সেটাকে অবশ্যই পছন্দ করত। এখন অনেকেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছেন, এর কারন ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কিছু করতে পারছে না, উল্টো মারামারি, হানাহানি আর দখলদারিত্বের মাধ্যমে নেতিবাচক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ছে।

আমাদের এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে পারব।

এহসান মাহফুজ:

আমি মনে করি ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা পরিশুদ্ধ করে শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে। মাথা ব্যাথা হলে কি মাথা কেটে ফেলা সমাধান নাকি ওষুধ দেয়া সমাধান! ছাত্ররাজনীতি না থাকলে দেশের নেতৃত্ব কোথায় থেকে তৈরি হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ছাত্ররাজনীতি করেই আজ তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন।

ছাত্ররাজনীতি না থাকলে তো ব্যবসায়ীরা নেতৃত্বে আসবে, নেতৃত্ব সংকট তৈরী হবে। ব্যক্তিত্বে,আচরনে, ব্যবহারে, কর্মে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসরন প্রয়োজন, তবেই গুনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্বের ঐতিহ্য সুন্দরভাবে ফিরে আসবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির চর্চা আরও বাড়ানো দরকার। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বে সংকট রয়েছে। প্রগতিশীল সংগঠন গুলো তাদের সাংগঠনিক চর্চা নিয়মিত রাখলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে। একজন ছাত্রনেতার মনে রাখতে হবে যে ছাত্রদের জন্যই তার রাজনীতি, তাহলেই ভালো রাজনীতি সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে, সেটি মনে রেখে প্রগতিশীল চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীবান্ধব, সচেতন, দেশপ্রেমী নেতৃত্ব তৈরি প্রয়োজন।

সুলতান আহমেদ রাহী:

এখন ছাত্রলীগ যে রাজনীতি করছে, তা মানুষকে কাঁদাচ্ছে, মেরে ফেলছে। আসলে এই রাজনীতি কি শিক্ষার্থীদের কোনো উপকার হচ্ছে? শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, ছাত্র রাজনীতি দেশের ভবিষ্যৎ এটা সর্বজন স্বীকৃত কথা আর ছাত্র রাজনীতি ছাত্র-ছাত্রী দাবী আদায়ের প্লাটফর্ম। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ৯০ স্বৈরাচার আন্দোলন, সড়ক নিরাপদ আন্দোলন, বেতন-ভ্যাট বৃদ্ধি আন্দোলন সহ সকল যোক্তিক আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতি একটা ঐতিহ্য লালিত হয়ে আসছে। একটা জীর্ণ সমাজ ভেঙ্গে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই ছাত্র রাজনীতির ধর্ম।

আর আমি ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে একমত নই।আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ছাত্র রাজনীতি। ভাষা আন্দোলন,স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ছাত্র রাজনীতি। আমাদের দেশে বর্তমান সংকটকালীন সময়েও ছাত্ররাই প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

প্রতিবাদী কন্ঠস্বর দমাতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার ষড়যন্ত্রে মত্ত একটি দেশী-বিদেশী মহল। একটি অশুভ শক্তি দেশের অভ্যন্তরে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। আমরা মনে করি তিনটি পক্ষ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে, ১.যারা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশ বিক্রি ষড়যন্ত্রে আছে ২. প্রতিবাদ কণ্ঠস্বর বন্ধ করে স্বৈরচারী শাষনব্যবস্থা সহায়তা করার ষড়যন্ত্রে যারা আছে ৩. মৌলবাদ, জঙ্গি যারা দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

ছাত্র রাজনীতিতে কিছু অসংগতি থাকতে পারে। তবে আপনার মাথা ব্যথা বলে মাথা কেটে দিতে হবে এমনটি ঠিক নয়। ছাত্র রাজনীতিতে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদের কোনো অবস্থান যাতে না থাকতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে সন্ত্রাসীদের দমন করতে হবে।

রিদম শাহরিয়ার!!

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এটি একটি ভয়ংকর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এবং সকল ধরণের বিরোধী মত এবং তার ভিত্তিতে সংগঠিত শক্তিকে দমনের একটি হাতিয়ার। এটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে একটি প্রতারণাও বটে। কার্যত বুয়েট চলে ৬১ ‘র অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যে অধ্যাদেশে বুয়েটে ইতোমধ্যেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ।

দ্বিতীয়ত, বুয়েটে গত এক দশকে ছাত্র রাজনীতি ছিলই না। শুধু ছিল রাজনীতির নামে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, নির্যাতন। প্রত্যেক ক্যাম্পাসে, হলে হলে টর্চার সেল গুলো একদিনে তৈরি হয়নি।

প্রশাসনের পৃষ্টপোষকতায় এই টর্চার সেল গুলো গড়ে উঠেছে। আমরা এর আগেও দেখেছি বিভিন্ন সময়ে এভাবেই প্রকাশ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন তকমা দিয়ে মারধর করার ঘটনা।

রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমাজের যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ, যেকোন রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তব্য, মতামত দেওয়ার অধিকার দমন করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার বলে আমি মনে করি।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.