রাবিতে মাদকের গন্ধ বাতাসে ভাসছে

রাবি প্রতিনিধি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকের বিচরণ যেন ফুলের গন্ধের মতো। ক্যাম্পাসের স্বল্প নির্জন স্থানগুলোতে সন্ধার পরপরই গোল হয়ে আসর জমে মাদকসেবীদের।

কেউ গাঁজা কেউ ফেন্সি হাতে, কেউ বা আবার ইয়াবা টানে। মুহুর্তেই বাতাসে ভেসে যায় মাদকের সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ। ৫০ থেকে ১০০ টাকা ডান হাতে নিয়ে বাম হাত বাড়ালেই মিলছে প্রয়োজন মাফিক মাদকদ্রব্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষার্থী, বহিরাগতসহ মাদকে লিপ্ত রয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরাও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার প্রদক্ষেপ নিয়েও মাদকসেবীদের ভয়াবহতা থামাতে পারছেন না। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে মাদকসেবীদের সংখ্যা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাম্পাসের অনেকগুলো স্থানে সন্ধার পর নাক উচু করলেই মাদকদ্রব্যের গন্ধ নাকের ডগায় পৌছে যায়।

গাঁজা, ইয়াবা ও ফেন্সিডেলের আসর ও বিভিন্ন উৎসবে হলগুলোতে মদ্যপানের ফলে গোটা ক্যাম্পাস এখন মাদক রাজ্যে পরিণত। এসব চিত্র এখন আর সন্ধ্যা বা রাতের বেলায় সীমাবদ্ধ নেই। দিনের বেলাতেও ক্যাম্পাসে গাঁজার আসর অহরহ চোখে পড়ছে।

মাদক সেবনের পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলাদা আলাদা গ্রুপ করা থাকে, নির্ধারণ করা থাকে স্থানও। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের হাকে মাদক সেবনের জন্য সবাই হাজির হন তাদের নির্দিষ্ট জায়গায়।

জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশ মাঠ, কৃষি প্রকল্পের গোডাউনের বারান্দা, বিনোদপুর গেট সংলগ্ন আইবিএস ভবন যাওয়ার রাস্তায় সৈয়দ আমীর হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায়, নবাব আব্দুল লতিফ হলের পূর্ব পার্শ্বের মাঠ, শাহ মখদুম হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায়,

শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পূর্ব দিকে রাস্তার পাশে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনের দুই পার্শ্বে, মাদার বখশ ও শহীদ জিয়াউর রহমান হলের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায়, শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনের মাঠে, চারুকলা ও কৃষি অনুষদ সংলগ্ন মাঠগুলোর অন্তত তিনটি পয়েন্টে, তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের পেছনে তুঁতবাগান এলাকায়,

দ্বিতীয় বিজ্ঞান ভবনের পেছনের ব্রীজে, চতুর্থ বিজ্ঞান ভবনের পেছনে চায়ের দোকানে, প্রথম বিজ্ঞান ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাঠে পানির ফোয়ারার নিচে, সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ও রবীন্দ্র কলা ভবনের ছাদে,

রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাজার গেটে রাস্তার পার্শ্বের মাঠে, পুরাতন ফোকলোর মাঠের পশ্চিম পার্শ্বে, জুবেরি মাঠের দক্ষিণ কোনাসহ আরো বেশ কয়েক স্থান।

স্থানগুলোতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বহিরাগতরাও অবাধে আসর বসিয়ে নিরবে সেবন করেন মাদকদ্রব্য।

তারা আরামে তাদের কর্ম সাধন করলেও সকাল হলেই পাওয়া যাচ্ছে হেরোয়িন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও মদের বোতলসহ বিভিন্ন প্রমাণাধির চিত্র। কোনো কোনো মাদক সেবক অবশ্য মজার ছলে ছাত্রীদের হলগুলোর সামনে কিংবা পাশে ফেলে আসছেন ফেনসিডিলের বোতল।

দু-চার মিনিটের ব্যবধানে কার্য সাধন করে উধাও হয়ে যাচ্ছে মাদকসেবীরা। ফলে চেনা যাচ্ছে না কে সে, ধরা যাচ্ছে না কাউকেই। শুধু ক্যাম্পাসের স্পট নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলেই এখন মাদক সেবন চলছে।

একটি সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র এবং বহিরাগতরা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রীও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। গত ১৬ আগষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজী ভবনের ছাদে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ১৬ জন শিক্ষার্থীকে আটক করেন।

যার মধ্যে মেয়ে ৪ জন। একজন মেয়ের ব্যাগ থেকে ৩ পিস ইয়াবা, ৩ প্যাকেট গাঁজা ও সিগারেট উদ্ধার করা হয়।

কিভাবে আসে এসব মাদকদ্রব্য সেই তথ্য জানতে গিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাহিরে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন ধরনের মাদক।

ক্যাম্পাস সংলগ্ন স্টেশন বাজার, মির্জাপুর, কাজলা, কাটাখালিসহ বিভিন্ন স্থানের নির্দিষ্ট একাধিক ব্যক্তির কাছে এবং দোকানে মিলে এসব মাদকদ্রব্য।

তাছাড়া নগরীর সাহেব বাজারের একাধিক স্থানে মদসহ অন্যান্য উত্তেজক দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাত ধরেই এগোতে হয় এসব পথে।

যতটুকু দ্রব্যের প্রয়োজন ততটুকুর উপর নির্দিষ্ট অর্থায়ন করলেই হাতে পৌছে যায় মাদক। এসব দালালীর কাজগুলো মূলত করে থাকে স্থানীয় যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী এবং প্রতিনিয়ত মাদকদ্রব্যে আনাগোনায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোঠাকয়েক শিক্ষার্থী।

স্থানীয় এক মাদক সরবরাহকারীর সাথে কথা হলে সে জানায়, আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। যদি আমাকে কেউ ফোনে বা সরাসরি মাদকের কথা বলে তাহলে কাজ শেষে সন্ধায় বাড়ি ফেরার সময় তাদের চাহিদা মেতাবেক নিয়ে আসি। আমার মাধ্যমে তারা পায় এবং আমাকেও ফ্রিতে খাওয়ায়।

আমার কাছে মূলত ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা এবং আমাদের স্থানীয় ছেলেরাই মাদকের জন্য আসে। বেশ কয়েকদিন আগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলে তার বান্ধবীসহও এসেছিলো।

আমরা এসব বিভিন্ন জায়গা থেকে পাই। ইয়াবা পেতে হলে একটু গোপনে খোঁজ রাখতে হয় আর গাঁজা পাওয়া খুব সহজ।

গাঁজা সেবনকারী বিশ্বদ্যিালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসের ভিতরেই আমাদের অনেক লিংক আছে। তারা খেয়ে যদি বাকি থাকে তাহলে বিক্রি করে। না হয় চলে যাই বাহিরে। বাহিরের অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযান চালানোর ফলে ক্যাম্পাসে এখন গোপনে এসব চলে। তবে বাহিরে একটা লিংক ধরতে পারলেই মাদক পাওয়া সহজ হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে এবং অনেকসময় হলের রুমে বসেই খাওয়া যায়।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিটিসি নিউজকে জানান, একাডেমিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকের দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা। তার উপর মাদক সহজলভ্য হয়ে গেছে।

গত দুদিন আগেও মাদকে ভেজালের ফলে প্রাণ গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীর। মৃত্যুতে তাদের যেমন অপরাধ ছিলো তার চেয়ে বেশি অপরাধ ছিলো যারা মেয়াদউত্তীর্ণ মাদক বিক্রি করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রশাসন বেশ অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ শুন্য। দিন দিন মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছেই। এসব ব্যাপারে প্রশাসনের নিয়মিত খোঁজ রাখা জরুরী। একদিন অভিযান চালিয়ে বাকি বছর খোঁজ না নিলে মাদক রোধ করা যাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। কিন্তু যদি কেউ ক্যাম্পাসের বাহিরে মাদক সেবন করে সেটা আমাদের জানা খুব কষ্টকর।

এজন্য সকলের সহযোগিতা দরকার। যাদের পরিচিতরা মাদক সেবন করছেন তারা যদি এসে আমাদের খবর দেন তাহলে তাদের ফিরিয়ে আনতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।

এছাড়া ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রয় ও সেবনের বিরুদ্ধে প্রক্টরিয়াল বডি ও পুলিশ সবসময় সক্রিয় রয়েছে।

 সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন।#

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.