রানা প্লাজা ধসের ৫ বছর স্থগিতাদেশে আটকে বিচার
বিটিসি নিউজ ডেস্ক : পাঁচ বছরেও এগোয়নি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্পভবন দুর্ঘটনায় (রানা প্লাজা ধস) ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক মৃত্যুর বিচার । আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুই হয়নি। একই অবস্থা ইমারত আইনের মামলারও। কেবল দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণের অভিযোগে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে।
সাভার রানা প্লাজা ধসের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১ জুন হত্যা এবং ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে হত্যা মামলায় রানা প্লাজার কর্ণধার সোহেল রানা, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাসহ ৪১ জনকে এবং ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা ধসে আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই পোশাকশ্রমিক। এ ঘটনায় পরদিন ২৫ এপ্রিল সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ।
ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ ছাড়া নিহত পোশাকশ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার খুনের অভিযোগ এনে আদালতে নালিশি মামলা করেন। সাভার থানা-পুলিশের করা মামলার সঙ্গে এই মামলাটির তদন্ত আদালতের নির্দেশে একসঙ্গে করা হয়।
এ ছাড়া দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভবন নির্মাণের অভিযোগে আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রধান সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, রানা প্লাজা ভবন ধসে মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত দুই বছর আগে ৪১ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেন।
বিচার শুরুর ওই আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে মামলা করলে আটজন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ আসে। এর ফলে মামলার আর সাক্ষ্য গ্রহণ নেওয়া সম্ভব হয়নি। ইমারত আইনের মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বলেন, ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ২০১৬ সালে ১৮ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
বিচার শুরুর ওই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চারজন আসামি রিভিশন মামলা করেন। সেই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে না। এর আগে হত্যা মামলায় ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করার অনুমতি না পাওয়ায় তিন বছর ঝুলে ছিল বহুল আলোচিত এই মামলা।
সে সময় জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল—যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের আসামি করার অনুমতি তাঁরা দিতে পারবেন না। তবে সরকারের অনুমোদন না পেলেও তাঁদের আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়েই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনার হত্যা মামলার সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানির তারিখ ছিল ১৫ এপ্রিল। মামলার নথিতে দেখা যায়, রাষ্ট্রপক্ষ সেদিন আদালতের কাছে সময় চান। আদালত আগামী ১৬ মে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন। এর আগে গত ৭ মার্চ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানির দিন ধার্য ছিল। সেদিনও সরকারি কৌঁসুলি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আদালতের কাছে সময় চান।
সেদিন তিনি আদালতকে জানান, তিনজন আসামির পক্ষে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ রয়েছে।রোববার সরকারি কৌঁসুলি আবদুল মান্নান জানান, হত্যা মামলার আসামি সাভার পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের ক্ষেত্রে কেবল উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে।
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় রানা প্লাজা ধসের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ আটকে আছে, তা কখনই জানানো হয়নি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে। রোববার রাতে তিনি বলেন, এত বড় আলোচিত মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ স্থগিতাদেশে আটকে আছে, তা কখনো জানানো হয়নি।
আক্ষেপের সুরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিচারিক আদালতের সরকারি কৌঁসুলি তো তাঁকে টেলিফোন করে কিংবা দেখা করে বিষয়টি জানাতে পারতেন। তিনি জানান, যখনই সরকারি যেকোনো দপ্তর থেকে তাঁর কাছে কোনো বিষয় জানানো হয় সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদক্ষেপ নেন।
স্থগিতাদেশের ব্যাপারে সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান জানান, স্থগিতাদেশ হওয়ার তথ্য লিখিতভাবে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে জানিয়েছেন। আদালত সূত্র বলছে, হত্যা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
এ মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে আবেদন করেন সাভার পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খান, মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. ইউসুফ আলী, ঢাকা বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. সহিদুল ইসলাম, সাবেক উপপ্রধান পরিদর্শক মো. আবদুস সামাদ, উপপ্রধান পরিদর্শক (সাধারণ, ঢাকা বিভাগ) মো. জামশেদুর রহমানের, সাবেক উপপ্রধান পরিদর্শক (সাধারণ, ঢাকা বিভাগ) বেলায়েত হোসেন, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, সাভার পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, গার্মেন্টস মালিক বজলুস সামাদ ও মাহমুদুর রহমান এবং ফরিদপুরের আবুল হাসান। গত বছরের ৭ আগস্ট বিচারিক আদালতের আদেশ থেকে আসামি ইউসুফ আলী, সহিদুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান, বজলসু সামাদ, রেফায়েত উল্লাহ ও আবুল হাসানের পক্ষের স্থগিতাদেশ থাকার কথা জানা যায়।
তবে গত ১০ জানুয়ারি আদালতের আরেক আদেশে দেখা যায়, আসামি মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষে স্থগিতাদেশ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ইমারত আইনের মামলায় ২০১৬ সালের ১৪ জুন সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
এ আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করেন পোশাক কারখানার মালিক আনিসুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, বজলুস সামাদ আদনান ও মাহমুদুর রহমান। আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে, আসামি বজলুস সামাদ ও মাহমুদুর রহমানের রিভিশন গত বছরের ১০ এপ্রিল খারিজ করেছেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
আরেক আসামি আমিনুল ইসলামের রিভিশন আবেদনের শুনানি শেষ হয়েছে। আদেশ দেওয়া হবে আগামী ৭ মে। আসামি আনিসুর রহমানের রিভিশনের শুনানি চলছে ঢাকার দেওলিয়াবিষয়ক আদালতে। সরকারি কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবীর বলেন, আসামি আনিসুর রহমান রিভিশন করেন ২০১৬ সালের ২০ জুলাই।
এরপর শুনানির জন্য তারিখ পড়েছে ১১ বার। অথচ প্রতিটি শুনানির তারিখে সময় নিয়েছেন তাঁর আইনজীবী। আসামিরা এভাবে বিচারকে বিলম্বিত করে চলেছেন। যে কারণে বিচার এগোচ্ছে না। আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে, হত্যা মামলায় ৪১ জন আসামির মধ্যে কেবল রানা প্লাজার কর্ণধার সোহেল রানা কারাগারে আছেন।
জামিনে ৩০ জন। পলাতক আছেন আটজন। মারা গেছেন দুই আসামি।সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান আশা করছেন, আইনি জটিলতা না থাকলে শিগগিরই রানা প্লাজা ধস ঘটনার হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। রাষ্ট্রপক্ষ বিচার শেষ করতে তৎপর রয়েছে। তিনি জানান, একজন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশের মেয়াদ ১২ মে শেষ হবে।
এরপরেই সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। রানা প্লাজা ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় ভবনের কর্ণধার সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত গত বছরের ২১ মে অভিযোগ গঠন করেন। ওই আদালতের পেশকার মো. রফিক বলেন, এ মামলার বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসে এতগুলো লোক মারা গেল—এর বিচার এভাবে বন্ধ থাকবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই মামলার বিচার যাতে বিচারিক আদালতে চলতে পারে, সে জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
রানা প্লাজা ধসের দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান পোশাককর্মী লাবনী বেগম। ডান হাত অকেজো। ডান কিডনিটিও নষ্ট। স্বামী হারানো এই নারী সোমবার বলেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ যাঁদের জন্য এত লোক মারা গেল, এত লোক পঙ্গুত্ব হলো, তাঁদের তিনি ফাঁসি চান।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বাঁ হাত হারান লাবনী বেগম। এখন থাকেন খুলনায়। আক্ষেপের সুরে লাবনী বললেন, যাদের জন্য আজ তাঁদের এ অবস্থা, তাদের বিচার এখনো হলো না, কোনো সাজা হলো না। এ কেমন কথা? #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.