রাজশাহী মেডিকেলে ‘তিক্ত’এক অভিজ্ঞতা

মোঃ আমানুল্লাহ আমান: ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯। পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন।  বিশ্বখ্যাত কার্টুনিস্ট জেফ স্মিথের জন্মদিনটির যুক্ত হলো আরও একটি স্মরণীয় ঘটনা । উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ মাওলানা সাদেকুল আলমের  সর্বকনিষ্ঠ কন্যা জাকিয়া তাবাসসুমের জীবনে ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ানো একটি ঘটনাবহুল দিন। ১৯৬১ সালে জন্ম নেয়া বিশ্ববিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় জেমস ওরথির জন্ম নেওয়া দিনটিও ছিল মেঘাচ্ছন্ন।

সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। হঠাৎ বাবার ফোন। আব্বু বলল, ‘জাকিয়া অসুস্থ, তোমার আম্মুরও শ্বাসকষ্টের সমস্যা। আউটডোরে (বহির্বিভাগ) দুটো টিকিট কেটে রাখ। তৎক্ষনাৎ বাসা থেকে দৌড়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের মেডিসিন বিভাগে দুটো টিকিট কাটলাম। এরই মধ্যে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে এক পসলা বৃষ্টিও হয়ে গেলো। আম্মু পথিমধ্যে কিছুটা ভিজে গেছেন। তবুও সাত মাসের ছোট্ট সন্তানটিকে একটুও ভিজতে দেননি। আব্বুকে সাথে নিয়েই ডাক্তারের চেম্বারে আম্মু ও জাকিয়া। ডাক্তারের পরামর্শে জরুরী বিভাগে ভর্তি করতে হলো। ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে বুঝলাম ডাক্তারের পরামর্শ মেনে নেয়ায় বোধহয় ভুল ছিল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দশ নম্বর ওয়ার্ড। তৃতীয় তলা। প্রচণ্ড দুর্গন্ধময় পরিবেশ। ঠাসাঠাসি ভিড়ে ফাঁকা নেই কোনো বিছানা। বরং এক বিছানাতে তিন-চারজন শিশুর শয্যাগত চিত্র দৃশ্যমান। আমরাও সেখানে। প্রচণ্ড অস্বস্তিকর লাগলেও একটাই উদ্দেশ্য, ৭ মাসের জাকিয়া তাবাসসুমের সম্পূর্ণ সুস্থতা। কর্তব্যরত নার্সরা ভর্তির কাগজপত্র দিলেন। এবার আসল খেলা শুরু।  খেলা তো নয়; এ যেন নরকের জ্বালা। সেটি যে ৭ মাসের নিষ্পাপ শিশুকে সহ্য করতে হবে কখনোই ভাবেননি গর্ভধারীনি মা। কেনই বা ভাববেন?  এর আগেও হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও নার্সরা এতটা অদক্ষতার পরিচয় দেননি। নার্সদের মাথাতেও যে ‘গোবর’ থাকে সেদিন তা স্বচক্ষে দৃশ্যমান হলো।

ভর্তির পর ক্যানেলা করার পালা। ইনজেকশন কিংবা স্যালাইনের সঠিক প্রয়োগের উপযুক্ত মাধ্যম এটি। ইন্টার্ন চিকিৎসককে চোখে না পড়ায় নার্সদের টেবিলে নেয়া হলো ক্যানেলার জন্য। পাশে আমি ও আব্বু। আম্মুর কোলে জাকিয়া। শুয়ানোর পর নার্স  সূচ বের করে ডান হাতে ফুঁড়লেন। চিৎকার দিয়ে উঠল। বের করে আবার ঢুকাল। আবারও চিৎকার।নার্স প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হলো। এবার বাম হাতে। আবারও কান্না। আব্বু শক্ত করে দুই পা চেপে ধরলেন। আমি স্থির দাঁড়িয়ে। নার্স বলল,রগ মিলছেনা। নার্স ব্যর্থ। এবার ডান পায়ে ফুঁড়া মাত্রই স্বজোরে চিৎকার। পারছেনা নার্স। সূচ বের করে এবার বাম পায়ে পুশ করে ঘুরানো শুরু করল! অসম্ভব কষ্টে কাতর হয়ে জাকিয়ার কান্নার আওয়াজে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে গেছে। কতটা নিষ্ঠুর হলে সাত মাসের বাচ্চার পায়ে সূচ ঢুকিয়ে এপাশ ওপাশ সূচ ঘুরাতে পারে?

আম্মু বেহুশ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় মাথা ঠুকে দিয়েছেন। সহ্য করতে পারছেন না সন্তানের কষ্টের চিৎকার। আব্বুও অনেকটা মন্থর হয়ে গেছেন। শিশুর চিৎকার আর চিৎকার। নিরব। নিস্তব্ধ। আমি যেন দাঁড়িয়ে থেকে কেন জগতে হারিয়ে গেছি। সূচ ঢুকানো আবারও শুরু করল। একে একে শরীরের চারটি অঙ্গে কমপক্ষে দশ জায়গায় ক্ষত করে দিল!  অন্য শিশুর স্বজনরা শুধু হায় হায় করছেন আর বলছেন এ কোন দশা? ইশ বাচ্চাকে এত কষ্ট দিচ্ছে! একটা ছোট্ট শিশু কিভাবে তা সহ্য করবে?  দেখেই শরীর শিহরিত হয়ে উঠছে! সূচ ঢুকিয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরাচ্ছে আর শিশু ছটপট করছে!  মুখ না ফুটা শিশুর কান্না ছাড়া যে কোনো ভাষা নাই সেটা কি বুঝে ওইসব অদক্ষ নার্স?  ততক্ষণে ক্ষত হয়ে শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে গেছে। শিশুর কান্না ছাড়া কোনো ভাষা নাই।
আম্মু বাকরুদ্ধ। নিশ্চুপ আব্বু।কারো মুখে কথা নেই। চিকিৎসা নিতে এসে শিশুকন্যার এমন হেনস্তা কখনোই কল্পনা করেননি।
নিরুপায় হয়ে নার্সদেরকে শুধু একটি কথাই জিজ্ঞেস করলাম,তাহলে এখন আমাদের করনীয় কি?

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তাদের মধ্য থেকে একজন উত্তর দিল ‘সরি’,আমরা পারছিনা; পরের শিফটে যারা আসবে ওদেরকে বইলেন ‘!
কি আজব আর হাস্যকর ব্যাপার! এরা নার্স?  জাতির সেবক?  সরকার এদেরকে প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন দিচ্ছে? যারা কিনা সামান্য ক্যানেলা করতেই অপারগ! যাদের কাছে সেবা শুশ্রূষার পরিবর্তে মিলল  শিশুর হেনস্থা,মায়ের বেহুঁশতা! দুচোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। এরা ডিপ্লোমা আর বিএসসি পাশ করা সুশিক্ষিত নার্স। তাদের এই মন মানসিকতা। এই দশা হাসপাতালের জরুরী বিভাগের?

গত ২২শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় সাংবাদিক সৌরভ হাবিব ভায়ের করা নিউজটির যথার্থই সত্যতা মিলল। বাস্তবেই যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের শুধু রাউন্ডেই পাওয়া যায় সেটি স্বচক্ষে দৃশ্যমান হলো। ক্ষত শরীরে শিশু জাকিয়ার চিৎকার।চারদিকে তাকালাম কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায় কি না। খুঁজে পাওয়া গেলোনা। এমবিবিএস শিক্ষার্থী হলেও চলবে। তাও পেলাম না। নার্সরা কোনোরকমে তুলা দিয়ে ক্ষতটা চেপে ধরতে বলল।

আম্মুকে কোনোরকমে সামলে আব্বুকে বিদায় দেয়া হলো। দায়িত্ব নিয়ে কোনোরকমে আম্মুকে সান্ত্বনা দিলাম। এবার ঘন্টাখানেক অপেক্ষা। এদল বিদায় হবে, অপরদল আসবে তারপর ক্যানেলা তারপর চিকিৎসা শুরু। ততক্ষণে কোনো স্বস্তির খবর নেই। আধাসুস্থ শিশুকে দশ দশটি জায়গায় ক্ষত চিত্র দেখার মতো ছিলনা।

কয়েকঘন্টা অপেক্ষা। নোংরা জায়গা, অস্বস্তিকর দুর্গন্ধময় পরিবেশ। থাকার মতো না হলেও চিকিৎসা নিতে ভর্তি হওয়া কিছু তো সুরাহা করতে হবে। শিশুর কষ্ট কি কেউ বুঝে?

অপরদল নার্স এসেই জাকিয়া,জাকিয়া ডাক। চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। বুঝতে দেরী হলোনা। পূর্বের ব্যর্থ নার্সদল পরের সহকর্মীদেরকেই লজ্জার কথা জানিয়ে গেছে। যাইহোক আবারও তাদের টেবিলে নেয়া হলো। এবারও কি একই দশা হয় নাকি। আম্মু খুব চিন্তিতই ছিলেন। অপেক্ষায় তাকিয়ে ছিলেন অন্য রুগীর স্বজনরা।

পূর্বের অবস্থার চেয়ে একটু সতর্কভাবে ইনজেকশন দিলেন। চিৎকার দিয়ে উঠল। আবারও রক্ত বেরিয়ে আসল। আবার ব্যর্থ!  আমরা কোথায় এসেছি? নার্স একের পর এক ব্যর্থ। ভুক্তভোগী শিশু। এ কেমন কথা?

একে একে নার্সরা হাতদ্বয় এবং দুই পা পুনরায় ফুঁড়লেন। রগ খুঁজেই পেলেন না। নিরুপায়। কিছু করার ছিলনা। মনে হচ্ছিল নার্স কোনো প্রতিশোধ নিচ্ছে। একদিকে জাকিয়ার চিৎকার, অপরদিকে আম্মুর টেনশন; চরম মর্মান্তিক পরিবেশ। সর্বশেষ চেষ্টা। এবার সূচ পায়ে ঢুকিয়ে চক্রাকারে ঘুরিয়ে আটকে দিলেন আর নার্স বললেন হয়ে গেছে। আর্তনাদ করে উঠল জাকিয়া। তারা দ্রুতই ব্যান্ডেজ করে দিলেন।কাঁদলেও শেষ পর্যন্ত ক্যানেলা হয়েছে সেটায় সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার শুকরিয়া। কিছু ওষুধপত্র দিলেন। চিকিৎসক এসে পরামর্শ দিলেন। আম্মু স্বাভাবিক হলেন; তবে দুশ্চিন্তা কমেনি। শিশুর শরীরে যে দশটি ক্ষত করে দিয়েছে নার্স পোষাকধারী একদল ‘পাষণ্ড নারী’।

২৭ শে ফেব্রুয়ারি ভর্তি হয়ে ছুটি দিল ২রা মার্চ। শনিবার বিদায় নেয়ার আগে কিছু ভাবনা মাথায় তো ঘুরপাক করছিলই। এই তো সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা!  এই তো নার্স! এজন্যই বোধহয় রামেক হাসপাতালে  সাংবাদিক প্রবেশে এত কড়াকড়ি। সেই ভয়েই  বোধহয় কিছুদিন আগে ৯ ই ফেব্রুয়ারি এটিএন নিউজে প্রচারিত সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে এটিএন নিউজের রিপোর্টার বুলবুল হাবিব ভাই বাধার সম্মুখীন।  আর ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা তো আরও ভয়াবহ। সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর প্রকাশ্য হামলা গণমাধ্যমকে এখনো নাড়া দেই।

যেখানে গুরুতর অবস্থায় রুগীর সেবার জন্য ‘ইমার্জেন্সি’ নাম রাখা সেখানে এমন অব্যবস্থাপনায়  ভরপুর থাকলে দেশবাসী কি সুফল পাবে?

তাই সরকারের সুনজর বিশেষভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ হস্তক্ষেপে অদক্ষ জনবল সরিয়ে চিকিৎসা বিভাগকে শতভাগ কলুষ মুক্ত করা। নতুবা এসমস্ত নিষ্ঠুর সেবিকারা জাকিয়ার মতো শিশুকে শুধু  কষ্ট দেয়া নয় ‘প্রাণ’ নিতেও পিছপা  হবেনা। আন্তরিকতা আর সত্যিকারের জনসেবাই হোক নার্সিং পেশার মূল লক্ষ্য – জনগণের সেটাই প্রত্যাশা। জাকিয়ার মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনার  পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে সেটাই কাম্য অভিভাবকমহলের। তবেই ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জনসেবা মানুষের হৃদয়ে পৌছবে। সার্থক হবেন  মহৎ পেশার অগ্রপথিকরা।

লেখক : কলামিস্ট, সাংবাদিক ও ধর্মীয় আলোচক।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.