রাজশাহী মহানগরীর ভদ্রা মোড়ে ৩০ লক্ষ শহীদদের স্মৃতি দাঁড়িয়ে আছে ‘স্মৃতি অম্লান’যা অনেকের অজানা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী মহানগরীর শহিদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের ভদ্রা মোড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক স্মৃতিস্তম্ভ, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘স্মৃতি অম্লান। বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে এর নামকরণ করা হয় অম্লান।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য রাজশাহীর অনেক মানুষই জানে না এটি সম্পর্কে।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত নারীদের স্মরণে এই স্মৃতি অম্লানটি তৈরি করা হয়। সেই থেকে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতি অম্লানটি রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাজশাহী নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) তত্ত্বাবধানে এই স্মৃতি অম্লানটি প্রতিষ্ঠিত করা হয় ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ।

তবে নগরীর স্মৃতি অম্লান সম্পর্কে অনেকের জানা নাই। ১৫-২০ জনের সাথে কথা বলে কেউ বলতে পারেনি স্মৃতি অম্লান সম্পর্কে। তাদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় মানুষ। অনেকেই বলছে এটি দেখতে দৃষ্টিনন্দন তবে এর ইতিহাস সম্পর্কে মানুষজন তেমন অবহিত না। অনেকের জানার আগ্রহ থাকলেও ব্যস্ততার কারণে শুনতে পারেন না বলে জানান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী  জানান, আমি রাজশাহীতে গত ৪ বছর ধরে আছি। প্রায় সময় এটির পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার সময় দেখি। আর এটির নাম শুনেছি। কিন্তু এটি সর্ম্পেক তেমন কিছু জানা হয়নি। তিনি আরো বলেন, এই স্মৃতি অম্লানটি সংস্কার করা দরকার কারণ স্মৃতি অম্লানটি অনেক ভ্রমণপ্রেমী মানুষেরা এক নজর হলেও দেখতে আসে।

ভদ্রার মুদি দোকানদার  বলেন, এই স্মৃতি অম্লান আমার পছন্দের। দেখতে অনেক ভালো লাগে। এটি সম্পর্কে অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে কেন এটি এখানে স্থাপন করা হয়েছে। আমি আমার সাধ্যমত তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি।

এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা সৌরভ জানান, এই স্মৃতি অম্লানটির নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের প্রতীক হিসেবে। শহিদ নির্যাতিত নারীদের স্মরণে এই স্মৃতি ‘অম্লান’টি তৈরি করা হয়। আর এটি সুদর্শন ও আকর্ষণীয়।

তিনি আরো বলেন, দেশের আর কোথাও এই ধরনের দৃশ্য আমার চেখে পড়েনি। এটি সর্বপ্রথম রাজশাহীতে আছে। আর এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অম্লান দেশের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি এটি।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) সূত্রে জানা গেছে, এটির মূল স্তম্ভটি একটি গোলাকার বেদির ওপরে স্থাপিত। গোলাকার বেদির উচ্চতা ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি, চওড়ায় ৪৫ ফুট এবং বেদির নিচে মূল স্তম্ভের ব্যাস ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। স্মৃতি ‘অম্লানের বেদিমূলে আছে নীল-অভ্র পাথরের আচ্ছাদন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রায় দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনের বেদনার প্রতীক হিসেবে এই পাথরের আচ্ছাদনকে দেখানো হয়েছে।

মূল গোলাকার বেদির কেন্দ্রস্থল থেকে তিনটি স্তম্ভ সরলভাবে ঊর্ধ্বমুখে স্থাপিত। এই তিনটি স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা ২৪ মিটার বা ৮০ ফুট। প্রতিটি স্তম্ভের বাইরের দিকে ২৪টি করে ধাপ রয়েছে। স্তম্ভের শীর্ষ প্রান্তে মূল স্তম্ভের ব্যাস ২.৮০ মিটার বা ৯ ফুট ২ ইঞ্চি। স্তম্ভ তিনটির শীর্ষে একটি গোলক রয়েছে। গোলকের ব্যাস ৩ মিটার বা ১০ ফুট। আর ভূমি থেকে গোলকের নিচ পর্যন্ত স্তম্ভের উচ্চতা ২১.৬৪ মিটার বা ৭১ ফুট। এই গোলক দিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এর মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে এবং স্বাধীনতার তীব্র উপস্থিতিকে সূর্যের প্রতীকে স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগতি নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়েছে এই ২৪টি ধাপ। এ ছাড়া প্রতিটি স্তম্ভে ১০টি করে মোট ছিদ্র রয়েছে ৩০টি। এই ৩০টি ছিদ্রকে একাত্তরের যুদ্ধে শহিদ ৩০ লক্ষ মানুষের অবদানের প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে। স্মৃতি অম্লান দেশের একটি অতুলনীয় স্থাপত্য। এই ধরনের স্থাপত্য নিদর্শন এবং প্রতীক উপস্থাপনা দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না।

স্মৃতি অম্লানের মূল পরিকল্পনা করেছেন তৎকালীন আরডিএর চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার আবদুর রব। এর প্রকৌশলী ছিলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ। আর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম ঠান্ডুর বাবা আজিজুর রহমান সরকার ।

আরডিএর অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, এই স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরী করলেও বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, এটি রং করা বা রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় কাজ করা হয় প্রতিনিয়ত। তবে স্মৃতি অম্লানের উত্তর পাশে একটি গার্ডেন আছে সেটির জন্য বরাদ্ধও পাওয়া গেছে। এখন তার উন্নয়ন করবে সিটি কপোরেশন।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.