রাজশাহী নার্সিং কলেজের কেনাকাটায় পুকুরচুরির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী নার্সিং কলেজের কেনাকাটায় পুকুরচুরির অভিযোগ উঠেছে। মালামাল ক্রয় না করেই বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থের ব্যয় প্রদর্শন করে আত্মসাতসহ অধ্যক্ষ ও প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের পাহাড় জমেছে।

এ প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা বহুল আলোচিত রুপপুরের বালিশ কেলেঙ্কারীকেও হার মানিয়েছে বলে জানা গেছে। রুপপুরে সরকারী বিধিমোতাবেক টেন্ডার আহবান করে বাজার দরের বহুগুণ বেশি দামে মালামাল ক্রয় করা হয়েছিল। কিন্তু রাজশাহী নার্সিং কলেজে টেন্ডার আহবান ছাড়াই মালামাল ক্রয় প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে বাস্তবে কোনো মালামাল ক্রয়ই করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় ৬৮ লক্ষ টাকার অডিট আপত্তির মাধ্যমে রাজশাহী নার্সিং কলেজে কেনাকাটার নামে পুকুরচুরির অভিযোগ সামনে আসে। মূলত এরপর থেকেই বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থের লুটপাট চলছে বলে অভিযোগ। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত বার্ষিক বরাদ্দ, ক্রয়ের টেন্ডার ও ক্রয় কমিটি, স্টক রেজিস্টার ও মালামাল যাচাই করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এছাড়া পুরাতন মালামাল বিক্রিতেও উঠেছে লুটপাটের অভিযোগ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত অডিট অধিদপ্তরের আপত্তিপত্রে বলা হয়, আসবাবপত্র, অফিস সরঞ্জামসহ আনুসঙ্গিক উপকরণ বাবদ ৩২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৫৫ টাকা খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি।

তবে একইপত্রে ১৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ১১৬ টাকা নিস্পত্তি এবং অবশিষ্ট ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার ৫৫০ টাকার মালামাল না কিনে ব্যয় প্রদর্শনের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করতে বলা হয়।

কিন্তু তৎকালীন অধ্যক্ষ সাদেকা খাতুন সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অর্থ ফেরত ছাড়াই ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি দিয়ে পার পেয়ে যান।

সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ মনিজ্জা খাতুনের আমলে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি বার্ষিক বরাদ্দ এনে একই কায়দায় আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান অধ্যক্ষ শেফালী খাতুনের বিরুদ্ধেও উঠেছে অর্থ আত্মসাতের একই অভিযোগ।

সূত্র মতে, উক্ত পুকুরচুরির নাটের গুরু হিসেবে পরিচিত প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা প্রায় ২০ বছর যাবত রাজশাহী নার্সিং কলেজ এবং ডিভিশনাল কন্টিনিউইং এডুকেশন সেন্টারে (ডিসিইসি) কর্মরত।

ফলে যখন যিনি অধ্যক্ষ হন, তাকেই অর্থের বিনিময়ে কব্জা করেন গোলাম মোস্তফা। এরপর যোগসাজস করে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ টেন্ডার ছাড়াই কেনাকাটার নামে আত্মসাত করেন বলে জানা যায়। এক্ষেত্রে ৫/১০ বছরেও নষ্ট হয় না, এমন একই মালামাল বারবার ভাউচারের মাধ্যমে ক্রয় দেখানো হয়। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব কলেজের সংশ্লিষ্ট কাউকে জানতে দেয়া হয় না।

অভিযোগ উঠেছে, ছোট পদে চাকরি করেও প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা মেয়েকে ঢাকায় প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ান। তানোরে ৭০ বিঘা জমি কিনেছেন। রাজশাহী শহরের চন্দ্রিমা এলাকায় চারতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়িসহ বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন।

এদিকে, বর্তমান অধ্যক্ষ শেফালী খাতুনের বিরুদ্ধে বার্ষিক বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ ছাড়াও ভর্তির সময় অস্বাভাবিক ফি আদায়, গোপনে নামমাত্র মূল্যে পুরাতন মালামাল বিক্রি, কলেজ পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ৩২ সিটের কোস্টার গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার ও একই ব্যক্তিকে দিয়ে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং অনুষদের প্রশ্নপত্র সেটার-মডারেটরের অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগীরা বিটিসি নিউজকে জানান, গতবছর প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় শিক্ষার্থী প্রতি প্রতি ৯ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। সনদপত্র যাচাইয়ের জন্য ৮০০ টাকা নেয়া হলেও কারও সনদ যাচাই করা হয়নি। কলেজে কমনরুম না থাকলেও ফি নেয়া হয়েছে ৪০০ টাকা।

এছাড়া ধর্ম বিষয়ক ও জাতীয় দিবস ফি ১০০০ টাকা, ল্যাব চার্জ ৪০০ টাকা, আন্ত:কলেজ পরীক্ষা ফি ৪০০০ টাকা আদায় উল্লেখযোগ্য। তবে ভর্তির সময় অর্থ আদায়ের সরকারি অর্ডার দেখাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন অধ্যক্ষ শেফালী খাতুন।

এ বিষয়ে নার্সিং অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক (শিক্ষা) ফাতেমা বেগম বিটিসি নিউজকে বলেন, সব মিলিয়ে ভর্তি ফি সাড়ে তিন হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এছাড়া কোন শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিল করলে টাকা ফেরত দেন না অধ্যক্ষ।

অন্যদিকে, নিলাম বিধি ভঙ্গ করে গত জুলাইয়ে ৬১টি আইটেমের ৫৫৭টি পুরাতন মালামাল গোপনে মাত্র ৪০ হাজার ৩৩০ টাকায় পছন্দের ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছেন অধ্যক্ষ।

ওইসব মালামাল নিলাম কমিটিতে অধ্যক্ষ নিজে সভাপতি, অনুগত নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর মাহফুজা খাতুন সদস্য সচিব। কমিটি ৬১টি আইটেমের মালামালের মধ্যে ৫৪টি নিলামযোগ্য, ১৩টি মেরামতযোগ্য ও ১টি ধ্বংসযোগ্য ঘোষণা করে।

প্রথমে নিলামযোগ্য ৫৪টি আইটেমের মূল্য ৭০ হাজার ৭৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরে সবগুলো আইটেম (মেরামতযোগ্যসহ) ৪০ হাজার ৩৩০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। মূল্য নির্ধারণের পর বিধিমোতাবেক নার্সিং অধিদপ্তরের অনুমোদন ও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নিয়ম থাকলে এক্ষেত্রে তা করা হয়নি।

এছাড়া একাডেমিক বা স্টাফ কাউন্সিল গঠন ছাড়াই স্বেচ্ছারিতার মাধ্যমে কলেজ পরিচালনা করে অধ্যক্ষ শেফালী খাতুন। কলেজে ৩০ জন শিক্ষক থাকলেও আন্তঃপরীক্ষাসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা কমিটিতে নিজে সভাপতি ও ঘনিষ্ট মাহফুজা খাতুন বিউটি ও রওশন আরা কচিকে সদস্য করেন।

এ সুবাদে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সেটার, মডারেটর, ভিজিলেন্সসহ সংশ্লিষ্ট সকল আর্থিক কাজেই অধ্যক্ষ নিজে ও তার অনুগত কয়েক শিক্ষককে নিয়োজিত করেন।

রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮সালের নার্সিং পরীক্ষায় একজন শিক্ষককে একই বিষয়সহ একাধিক বিষয়ের প্রশ্নপত্রের সেটার-মডারেটর এবং একজন শিক্ষককে একইদিনে একই সময়ে একাধিক বিষয়ের মৌখিক ও ব্যবহারিকের পরীক্ষক বানিয়ে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।

কলেজের ক্লাস রুটিনেও বিভিন্ন পরীক্ষায় নিয়োজিতদের প্রাধান্য দেয়া হয়। অন্য শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষার কাজ চাইলে অভিজ্ঞতা নেই বলে অসম্মান করেন। কিন্তু নার্সিং অধিদপ্তরের অদৃশ্য ক্ষমতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পান না। সম্প্রতি একজন শিক্ষক এবং একজন অফিস সহকারী তাদের রোষাণলে পড়ে প্রশাসনিক শাস্তির শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান সহকারী গোলাম মোস্তফা অধ্যক্ষের সাথে কথা বলতে বিটিসি নিউজকে বলেন। অধ্যক্ষ শেফালী খাতুন কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি সাইদুর রহমান। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.