নিজস্ব প্রতিবেদক: চাঁদাবাজির পথ ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরে এসেছেন রাজশাহীর তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য মিস পলি খাতুন। বুটিকের ব্যবসা শুরু করে তিনি পেয়েছেন সফলতা। মাত্র আট হাজার টাকায় শুরু করলেও এখন তার মূলধন অনেক বেশি। ব্যবসায় সফলতার কারণে পেয়েছেন সরকারের ‘জয়িতা’ পুরস্কারও।
মিস পলি রাজশাহী মহানগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন তার ‘ডি এ ফ্যাশন হাউজ’। তার এই ফ্যাশন হাউজে সার্বক্ষণিক ২০ জন লোক কাজ করেন। এদের মধ্যে ১০ জনই তৃতীয় লিঙ্গের বা হিজড়া জনগোষ্ঠির সদস্য। নিজ বাড়িতে বাবা-মাকে রেখে তাদের দেখভালও করেন পলি। নারীদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণও দেন এখানে।
তবে শুরুর সময়টা মোটেও ভাল ছিল না। জয়িতা পলি এমন কথায় জানিয়েছেন। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকি তাকে টানত। হিজড়াদের বিভিন্ন সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তিনি বেসরকারি সংস্থা ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র সঙ্গে পরিচিত হন। ২০১৩ সালে তিনি সংস্থাটি থেকে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ১৭ জন কর্মীকে নিয়ে বুটিকের কাজ শুরু করেন। তারপর বিভিন্ন স্থানে তার ফ্যাশান হাউজের হাতের তৈরি শাড়ী, থ্রি-পিস, বেড সীট ও কুশন কভার পাঠাতে শুরু করেন। বিক্রি শুরু হতে থাকে। কিন্তু তার পরিচয় নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে।
পলি বলছিলেন, ঢাকার একজন নারী তার পণ্য খুব পছন্দ করলেন। তিনি এসব কিনতে তার ফ্যাশান হাউজে এলেন। কিন্তু আসার পর যখন তিনি দেখলেন পলি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, তখন তিনি আর পণ্যগুলো কিনলেন না। ঢাকায় ফেরার পর তিনি জানিয়েছিলেন এসব আর নিবেন না। এ রকম হোঁচট তাকে খেতেই হয়েছে। তবে থেমে যাননি। প্রথম দিকে স্কুল-কলেজে গিয়ে তার পণ্য বিক্রি করেছেন। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলায় অংশ নেয়ার কারণে এখন তার ফ্যাশান হাউজের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখন এমনিতেই অর্ডার আসে। ইংল্যান্ড এবং ভারতেও গেছে তার ফ্যাশান হাউজের পণ্য। এখন তিনি পরিবারের সঙ্গেই থাকেন। ভালই আছেন। হিজড়া জনগোষ্ঠী এবং নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন।
পলির কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা-২০২০ এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে করোনাকালীন ‘মানবিক যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পলির ফ্যাশান হাউজ থেকে তৈরি এক একটি থ্রি-পিস বিক্রি হয় আড়াই হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায়। ওয়ান পিস বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। এছাড়া টু-পিস দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় এবং শাড়ি বিক্রি হয় আড়াই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে পলির দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়।
পলি জানিয়েছেন, বুটিকের কাজের মধ্যে নারীত্বের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তিনি নিজেকেই নারীই মনে করেন। তাই এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার ফ্যাশান হাউজের অধীনে এখন চারশোর বেশি নারী কাজ করেন। আছেন ১৯ জন হিজড়াও। এর মধ্যে তিনজন তার স্থায়ী কর্মী। বাকিরা চুক্তিভিত্তিক। পলি চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সকল সামগ্রী সরবরাহ করেন। তারা কাপড়ে হাতের কাজ করেন। এরপর পলির ফ্যাশান হাউজে দেন। এ জন্য পলি সবাইকে পারিশ্রমিক দেন।
জয়িতা পলির প্রতিষ্ঠানে চার বছর ধরে কাজ করছেন হিজড়া জনগোষ্ঠির রুবিনা। এখানে তিনি কাপড়ে ডিজাইন করা, প্রিন্ট করা, সেলাই, চুমকি ও পাথর বসানোসহ সব ধরনের কাজ করেন। রুবিনা বলেন, আগে আমি আদি পেশার সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এখানে এসে কাজ শুরুর পর আমার নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে পারি। মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়।
পলির কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের কাজ করেন নগরীর হড়গ্রাম শেখপাড়া এলাকার আজমিরা বেগম। তিনি বলেন, দুই বছর ধরে পলির কাছ থেকে থ্রি-পিস ও শাড়ি নিয়ে পাথর ও চুমকি বসানোর কাজ করেন। এজন্য তিনি একটা থ্রি-পিস বাবদ ৩৫০ টাকা ও একটি শাড়ি বাবদ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পান। তার সাথে দুই বছর ধরে কাজ করলেও এখন লেনদেন নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কাজ শেষেই পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেন পলি।
পলি বলেন, আমার অধীনে যারা কাজ করেন তারা যখন এসে টাকা চান, আমার খুব ভাল লাগে। তারা এসে বলে- আপা, কিছু টাকা দেন। বাচ্চার স্কুলে দিতে হবে অথবা অন্য কোন দরকার আছে। তখন আমার খুব ভাল লাগে। মনে হয়, আমি তাদের একটা আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছি এবং এই টাকা নিয়ে তারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন। এটা আমার কাছে সুখের বিষয়।
জয়িতা পলি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠির হলেও আমাকে আদি পেশায় নামতে হয়নি। বরং অনেক হিজড়া জনগোষ্ঠির মানুষকে আমি কর্মের ব্যবস্থা করে তাদের আদি পেশা থেকে সরিয়ে এনেছি। হিজড়া নন এমন নারীদেরও আমি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। রাজশাহী ও নাটোরের নারীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, শুরুতে জেন্ডার আইডেনটিটির কারণে আমাকেই অনেক প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হিজড়া জনগোষ্ঠির হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক ঋণ দেয়া হয়নি। অনেকবার ব্যাংকে ঘুরেও ঋণ পাননি। আর তাই এখন আর ব্যাংকে যায় না। এগিয়ে যাচ্ছি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.