রাজশাহীর পুঠিয়ায় চলছে গণহারে পুকুর খনন!

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর পুঠিয়ায় কৃষকদের মানবন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পরেও শস্য ভান্ডার খ্যাত শিলমাড়িয়া, ভাল্লুকগাছী ও জিউপাড়া ইউনিয়ন এলাকায় থামানো যাচ্ছে না পুকুর খনন।
ইউএনও এ, কে, এম নূর হোসেন নির্ঝর পুঠিয়ায় যোগদানের পরে গত বছরের জুলাই মাস থেকে পুকুর খননের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ফলে পুকুর খননকারীরা আতঙ্কিত হয়ে কিছুদিন পুকুর খনন বন্ধ রাখেন। কিন্তু কিছুদিন বন্ধ রাখার পরে আবারো বেপরোয়া গতিতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গণহারে ফসলি জমি কেটে পুকুর খনন শুরু করেন তারা এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে জমি ভরাটের কাজ।
এদিকে কৃষি ফসল উৎপাদনে বেশি শ্রম দিয়েও কাঙ্খিত ফল না পাওয়ায় কম শ্রম ও ঝামেলাবিহীন অর্থ উপার্জন করতে ফসলি জমি কেটে পুকুর করছেন বলে জানিয়েছেন অনেক কৃষকেরা। কেউ নিজে পুকুরে মাছ চাষ করছেন, আবার অনেকে বড় অর্থের বিনিময়ে মৎস্যচাষিদের কাছে পত্তনী (লিজ) রাখছেন পুকুর। ফলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে মত বিশিষ্টজনদের।
এই উপজেলার মাটি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায়, আলু, পটল, বেগুন, পিঁয়াজ, রসুন, ধান, গম, পাট, ভুট্টা, তিল-সহ বছরে তিনটি ফসল ফলে। সেই জমি নির্বিচারে কেটে পুকুর করছেন কৃষকেরা। বিশেষ করে গত শীতের মৌসুমের শেষ দিক থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে দিনরাত চলছে পুকুর খনন কাজ। এই সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। এতে কমে যাচ্ছে তিন ফসলি উর্বর জমি।
অন্যদিকে, পুকুর খননের কাদামাটি বিক্রি করার জন্য সড়কের ওপর দিয়ে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। তখন সড়কগুলো কর্দমাক্ত হয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি রাস্তাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিভিন্ন ইউনিয়নে সরোজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন উপজেলার বানেশ^র ইউনিয়নের হাতিনাদা গ্রামে ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন, ভাল্লুকগাছি ইউনিয়নের কৈপুকুরিয়া গ্রামে হাসেম উদ্দিন, ফুলবাড়িয়া মহনপুর গ্রামে মজিবর ইসলাম ও পশ্চিম ভাগ এলাকায় ইউপি সদস্য জুয়েল হোসেন।
এছাড়া জিউপাড়া ইউনিয়নের বিলমাড়িয়ায় পুকুর খনন করছেন তোকিয়া ঢালান এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হোসেন। তবে এই খননকাজ উপজেলা প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আবার শুরু করেছে।
এদিকে শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের বাগপাড়া গ্রামে পুকুর খনন করছেন, পুঠিয়া-দূর্গাপুরের সাবেক সংসদের ভাই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন ও ভেকু ঠিকাদার সোহেল এবং সেন্টু, একই ইউনিয়নের নান্দিপাড়া গ্রামে ছৈয়ব আলী ও ভেকুর ঠিকাদার শিশির মোল্লা, ছাতারপাড়া গ্রামে হাফিজুল ইসলাম ও সাইদুর রহমান, রাতোয়াল গ্রামে ভেকুর মালিক শামিম, নাইম ইসলাম, রানা ও বাবু, টুলটুলিপাড়া গ্রামে নাটোর সদর উপজেলার ভেকুর ঠিকাদার নয়ন, হানিফ ও দিপু, আমঘোষপাড়া কার-পুকুর গ্রামে মজিদ ইসলাম মহা ধুমধামের সাথেই ফসলি জমি কেটে পুকুর খনন করছেন।
অন্যদিকে শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য ফারুক হোসেন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাজুপাড়া গ্রামে পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করেছেন মোল্লাপাড়া এলাকার একটি ইটভাটায়।
এদিকে সাতঘোষপাড়া গ্রামে জোর করে পুকুর খননের চেষ্টা করছেন বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌরসভার কাউন্সিলর এরশাদ আলী ও কাউন্সিলর কার্তিক। এছাড়া সাধনপুর, মঙ্গলপাড়া, নান্দিপাড়া-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে পুকুর খননের জোর প্রস্ততি চলছে বলে জানা গেছে।
পুকুর খননকারী বাগমারা উপজেলার এক ঠিকাদার ও পুকুর ব্যবসায়ী সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি পুকুর খননে বিঘা প্রতি ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ওপর মহলকে দিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভেকুর ঠিকাদার বলেন, সাংবাদিকরা বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিবে। আর আমরা ভৃমি অফিস-সহ বিভিন্ন দফতরে টাকা দেই। তাই পুকুর খননে কোনো সমস্যা হয় না।
পুকুর খননকারী ফারুক হোসেন বলেন, বাড়ির পাশের জমিতে ফসল তেমন হয় না। সে জন্য পুকুর দেওয়া হচ্ছে। মাছ চাষে লাভ বেশি। সরকারি অনুমোদনের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।
শিলমাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অসাধু মাটি ব্যবসায়ীরা মাটি বিক্রি করতে পুকুর খননের কাদামাটি পাকা সড়কের উপর দিয়ে বহন করায় সড়কগুলো কর্দমাক্ত হয়ে যানবাহন দূর্ঘটনার কবলে পড়ছে। এছাড়াও পাকা ও কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিছু কিছু রাস্তা জনসাধারণের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভৃমি) দেবাশীষ বসাক বলেন, ফসলি জমি খনন ও ভরাটসহ নতুন-পুরাতন কোন জলাশয় কিংবা ফসলি মাটি খননের অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। সরকারি অনুমতি ছাড়া জমির মালিক বা কোন ব্যক্তি পুকুর খনন ও ভরাট করছে এমন অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ভেকুর ঠিকাদার নয়ন-সহ বেশ কয়েকজনের জরিমানা আদায় ও কয়েকটি ভেকু মেশিন অকেজোর পাশাপাশি ৫০টির মতো ব্যাটারী জব্দ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুঠিয়া থানার অফিসার ইনর্চাজ সাইদুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিটিসি নিউজকে বলেন, আমি একটি মিটিংএ আছি বলে ফোন কেটে দেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ.কে.এম নূর হোসেন নির্ঝর বিটিসি নিউজকে বলেন, আবাদি জমিতে পুকুর খনন ও ভরাটের অভিযোগ পাওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তা বন্ধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যারা পুকুর খনন ও জমি ভরাটের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে পুকুর খনন বন্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো. মাসুদ রানা রাব্বানী / রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.