রাজশাহীর গ্রামেও ছড়াচ্ছে করোনা, ঘরে বসে সর্দি কাশি জর

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীতে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় সাতদিনের সর্বাত্মক লকডাউন দেয়া হয়েছে। তবে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। রাজশাহীর উপজেলাগুলোর বাড়িতে বাড়িতে এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টের রোগী। শহর থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে লাগোয়া রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার অবস্থা বেশি খারাপ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের ৪০ ভাগই আসছেন গ্রাম থেকে। তাঁরা এতটা দেরি করে আসছেন যে কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। এ অবস্থায় শহরের মত গ্রামেও লকডাউন দেয়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা থেকে মঙ্গলবার (১৫ জুন) দুপুরে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাহমিনা বেগমকে (৫৫)। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টা ২০ মিনিটে তিনি মারা যান। তাহমিনা বেগম করোনা পজিটিভ ছিলেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার দামকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সুমি বেগমকে (৩৯) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ১৩ জুন। গত মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে তিনিও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সুমি ছিলেন ২২ নম্বর ওয়ার্ডে।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাসিন্দা শাহানারা বেগমকে (৫০) রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল ১৩ জুন। গত মঙ্গলবার তাঁরও মৃত্যু হয় ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে। শাহানারাও করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। একই দিন মারা যান রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম (৩৮)। এভাবে গ্রামের মানুষও মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও।
অথচ রাজশাহীর সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৫ মার্চ রাজশাহীর ৯ উপজেলার কোথাও করোনা রোগী ছিল না। সেদিন শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪৩ জন। এর একমাস আগে ১৫ এপ্রিল রাজশাহীর ৯ উপজেলায় ৬০ জন শনাক্ত করোনা রোগী ছিলেন। আর গত ১৫ মে ৯ উপজেলায় রোগীর সংখ্যা কমে ২২ জনে দাঁড়ায়। এর একমাস পর মঙ্গলবার ১৫ জুন জেলার ৯ উপজেলায় রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৭৬০ জনে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবারের হিসাব অনুযায়ী, জেলার বাঘা উপজেলায় ৫৮ জন, চারঘাটে ৮৫ জন, পুঠিয়ায় ১০২ জন, দুর্গাপুরে ৯৩ জন, বাগমারায় ১১৪ জন, মোহনপুরে ৫১ জন, তানোরে ১২৫ জন, পবায় ৪৩ জন এবং গোদাগাড়ীতে ৮৯ জন করোনা রোগী আইসোলেশনে ছিলেন। আর রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় আইসোলেশনে ছিলেন ৩ হাজার ৭৩০ জন। গ্রাম ও শহর মিলিয়ে জেলায় মোট আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তির সংখ্যা ৪ হাজার ৪৮১ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় জেলা ও মহানগরে মোট ৩৪৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রাজশাহী মহানগরে ২৬৫ জন, বাঘায় ১২ জন, চারঘাটে নয়জন, পুঠিয়ায় ছয়জন, দুর্গাপুরে ১৬ জন, বাগমারায় ১৫ জন, মোহনপুরে ছয়জন, তানোরে সাতজন, পবায় তিনজন এবং গোদাগাড়ীতে চারজন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ১ হাজার ৫৮১টি নমুনা পরীক্ষায় তাঁরা শনাক্ত হয়েছেন। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ। আরটি-পিসিআর, জিন এক্সপার্ট ও র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট মিলে এই গড় করা হয়েছে। তবে রাজশাহীর দুটি আরটি-পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ৪৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এদিকে বয়স্ক ব্যক্তিদের পাশাপাশি এখন অল্প বয়সীরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মারাও যাচ্ছেন। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন করোনার উপসর্গ নিয়ে। গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর পশ্চিমপ্রান্ত গুড়িপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফরমান আলী তাঁর ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে আসেন রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছিল মেয়েটি।
শ্বাসকষ্টের কারণে মেয়েটিকে জরুরি বিভাগেই অক্সিজেন মাস্ক দেয়া হয়েছিল। তাও যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে। বাবাকে জড়িয়ে ধরেই স্বস্তি আসছিল না। যন্ত্রণায় ঢলে পড়ছিল। বাবা ফরমান আলী মেয়েকে ধরে সান্তনা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হবে, কষ্ট কমে যাবে। ফরমান আলী জানিয়েছেন, আগে কখনও তাঁর মেয়ের এমন শ্বাসকষ্ট হয়নি। মঙ্গলবার সকাল থেকেই হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। তবে তাঁর করোনার পরীক্ষা করা হয়নি।
রামেক হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ১৩ জনের মধ্যে তিনজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১২ জনের মধ্যে মারা যাওয়া ১২ জনের মধ্যে তিনজনের বয়স ছিল ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন ধনী-গরীব, অলস-কর্মঠ, বেশি-কম বয়সী কিছু দেখছে না। সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। তাই মানুষের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পারবে। গ্রাম এবং শহরে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন দেয়া গেলে ভাল ফল পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
গত শুক্রবার (১১ জুন) বিকাল ৫টা থেকে রাজশাহী শহরে সাতদিনের সর্বাত্মক লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। এই লকডাউনের সময়সীমা শেষ হবে ২৪ জুন মধ্যরাতে।
লকডাউনের পরিধি বাড়ছে কিনা জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা রাত ৮টায় মিটিং করব। আপনারা আমন্ত্রিত। মিটিং শেষে ব্রিফ করা হবে।’ সাতদিনের লকডাউনে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আপনি কৌশলে মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত আগেই জানার চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে এখন কিছু বলা যাবে না। মিটিং শেষেই ব্রিফ করা হবে।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো: মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.