রাজশাহীর আমচাষীদের অনাবৃষ্টি শিলাবৃষ্টি কুয়াশায় স্বপ্ন স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর আমচাষিরা কিছুদিন আগেও যে স্বপ্ন দেখছিল, তা এখন গল্প মাত্র। প্রকৃতির খাম খেয়ালী আম চাষীদের সপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে।
গাছে গাছে যখন স্বর্ণালী মুকুল, তখন হঠাৎ কয়েকদিন কুয়াশা। ক্ষতি হলো মুকুলের। চাষিদের পরিচর্যার মধ্য দিয়ে সবুজ পাতার ভেতর থেকে উঁকি দিল আমের গুটি। ধীরে ধীরে তা কড়ালিতে পরিণত হলো। তখন বৃষ্টির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বৃষ্টি হলো না। অনাবৃষ্টির মধ্য দিয়েই যখন কড়ালিগুলো বড় হচ্ছিল, তখন নেমে এলো ঝড় আর শিলাবৃষ্টি। ক্ষতি হলো আরেকদফা।
এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজশাহীর আমচাষিদের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। তারা বলছেন, প্রথম দিকে যে লাভের আশা তারা করেছিলেন, এখন তার অর্ধেক ভাবতে হচ্ছে।
সর্বশেষ গত রোববার বিকালের শিলাবৃষ্টিতে আমের সর্বনাশ হয়ে গেছে। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় বাঘা ও চারঘাট উপজেলায়। গত রোববার এ দুই উপজেলাতেই ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হয়েছে।
শিলার আঘাতে আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব আমের বোটা থেকে বের হয় কষ। আমের যে স্থান থেকে কষ বের হয় সেই স্থানে পোকার আক্রমণ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এই আম থেকে ভাল আমে যেন কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য শিলাবৃষ্টির পরদিন সকাল থেকেই চাষিরা নেমে পড়েছেন পরিচর্যায়।
সরেজমিনে ঘুরে বাগানে বাগানে চাষিদের ব্যস্ততা দেখা গেছে। চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিলাবৃষ্টির পর তাদের সবার মন খারাপ। তারা উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
চারঘাট উপজেলার জোতকার্তিক গ্রামে গত সোমবার সকাল ৮টায় বাগানে কীটনাশক স্প্রে করে ফিরছিলেন এক চাষী, তিনি জানালেন, ২৫ বিঘা জমিতে তাদের ৩০০টি আমগাছ আছে। প্রতিবছর সাত থেকে আট লাখ টাকার আম বিক্রি করেন। এবার কুয়াশা, অনাবৃষ্টি আর শিলাবৃষ্টির কারণে অর্ধেক আমেরও আশা করতে পারছেন না।
আরেক চাষী জানান, গত রোববার দুপুর আড়াইটা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত একঘণ্টা শিলাবৃষ্টি হয়েছে। অথচ গত অক্টোবরের পর তাদের এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। শিলার আঘাতে একেবারেই ফাকা হয়ে যাওয়া একটি আমগাছ দেখিয়ে  বললেন, ‘খালি ডগা, আম নাই। সব ঝরি পড়িছে। আমার তো সর্বনাশ হয়ি গেল।’
চারঘাটের কালুহাটি বাজারের একজন আম চাষী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানালেন, তার দুটি বাগান আছে। সকালে একটি বাগান তিনি দেখে এসেছেন। আমের কড়ালি অনেক ঝরে গেছে। আরেকটি বাগান ছেলেকে দেখতে পাঠিয়েছেন। শিংড়িকান্দি গ্রামে বাগানে ওষুধ স্প্রে করছিলেন কামরুল ইসলাম।
তিনি জানালেন, তার বাগানের ৬০টি আমগাছ আছে। সব গাছেরই ছোট ছোট আম ঝরেছে। এসব আম কুড়িয়ে আচারের জন্য বিক্রি করারও উপযোগী নয়। শিলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত আম থেকে যেন ভাল আমে কীটপতঙ্গের আক্রমণ না হয় তার জন্য তিন ধরনের কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে।
পাশের বাঘা উপজেলার রুস্তমপুর ভারতীপাড়া গ্রামের একজন বাসিন্দা বললেন, ‘গাছে এবার খুউব মুকুল আসছিল। এখন তো আম ঝরি পড়ল। এক ঘণ্টার উপরি শিল হইছি। গাছে যে আম আছে তা টিকাতি হোলি এখুন আবার বিষ করতি হোবি। আবার খরচ।’
বাঘার আড়পাড়া গ্রামের এক বড় আমচাষি  জানালেন, তার প্রায় এক হাজার আমগাছ আছে। এবার সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া, কুয়াশা আর শিলাবৃষ্টির কারণে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসার আশঙ্কা করছেন তিনি। তবে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আরও তিন-চারদিন পর ভালভাবে বোঝা যাবে। এই সময়ের মধ্যে শিলার আঘাত পাওয়া আমগুলো ঝরে পড়বে।
বাঘা-চারঘাটের প্রায় সব রাস্তার দুইপাশে আমবাগান। রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ই বাগান থেকে ছোট ছোট আম কুড়িয়ে শিশুদের ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেল। বাগানে বাগানে দেখা গেল চাষিদের ব্যস্ততা। চাষিরা জানালেন, হঠাৎ করে একদিনে সব চাষি বাগানে স্প্রে করার কাজ শুরু করার কারণে এই কাজের সঙ্গে যে শ্রমিকেরা জড়িত তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিকের সংকটে চাষিরা নিজেরাই বাগানে স্প্রে করতে শুরু করেছেন।
স্প্রে মেশিন চাষিরা বাজারের দোকান থেকে ভাড়া করে আনেন। বাঘার আড়পাড়া বাজারের মেসার্স সজিব মেশিনারিজ থেকেও এসব স্প্রে মেশিন ভাড়া দেয়া হয়। আগে ব্যাটারিচালিত স্প্রে মেশিন একবেলার জন্য ১০০ টাকায় ভাড়া দেয়া হতো। আর শ্যালো ইঞ্জিনচালিত স্প্রে মেশিনের একবেলার ভাড়া ছিল ৪০০ টাকা। শিলাবৃষ্টির পর সোমবার এসবের ভাড়া নেয়া হচ্ছে দ্বিগুণ। তারপরও চাষিরা নিয়ে যাচ্ছেন। বেলা ১১টার মধ্যে সজিব মেশিনারিজের সব মেশিন ভাড়া চলে যায়।
গত রোববারের শিলাবৃষ্টিতে চাষিরা আমের ব্যাপক ক্ষতির কথা জানালেও তা স্বীকার করেনি কৃষি বিভাগ। বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ সুলতান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়নি। যেগুলো ঝরেছে, সেগুলো ঝরতোই। এখন আম একটু পাতলা হয়েছে। এগুলো আরও ভালভাবে বড় হবে। এগুলো আর ঝড়ে পড়বে না। উৎপাদন ঠিক থাকবে।
একই কথা জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) উম্মে ছালমা বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, রাজশাহীর ৯ উপজেলার মধ্যে শুধু বাঘা-চারঘাটেই একটু শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে দু’একটা আম ঝরলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না। আমের পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত ভাল।
রাজশাহীতে এ বছর ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। গত বছর ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। এবার বাগান বেড়েছে ৩৭৩ হেক্টর জমিতে। এ বছর হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে জেলায় এ বছর মোট দুই লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.