রাজশাহীতে তামাকের বিজ্ঞাপন-প্রণোদন বন্ধে পদক্ষেপ জরুরী : সালীমা সারোয়ার

সালীমা সারোয়ার: তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী যে কোনো ধরনের তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু ইদানিং করোনাকালে রাজশাহী মহানগরীর তামাকপণ্যের দোকানগুলোতে এই অবৈধ বিজ্ঞাপনে সয়লাব হয়ে গেছে।

তবে রাজশাহী জেলা প্রশাসন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে তামাকের এসব অবৈধ বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

আমরা লক্ষ্য করছি, তামাকের অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধে কয়েক মাস আগেও রাজশাহী জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তামাকের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে জেল-জরিমানা করেছিলেন।

তবে করোনাকালকে তামাক কোম্পানিগুলো সুযোগ হিসেবে নিয়ে দেদারছে অবৈধ বিজ্ঞাপন আর বেপরোয়া প্রচারণা চালাচ্ছে। অথচ এসব অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধে প্রশাসনকে বর্তমানে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না বলে মনে হচ্ছে। চটকদার এসব বিজ্ঞাপন-প্রণোদনায় আকৃষ্ট হয়ে নতুন প্রজন্ম তামাকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।

যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত দেশ হিসেবে গড়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রাজশাহীতে তামাকপণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হচ্ছে।

রাজশাহী মহানগরীর অভ্যন্তরে ২ হাজার ৭৩৬টি তামাকপণ্যের দোকান রয়েছে বলে গত বছর ‘এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি’র এক জরীপে উঠে আসে। ধূমপানে আকৃষ্ট করতে বর্তমানে এই দোকানগুলোর অধিকাংশ দোকানেই কোম্পানিগুলোর অবৈধ বিজ্ঞাপনে ভরপুর হয়ে গেছে।

অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, এসব বিজ্ঞাপন ও পুরস্কার-প্রণোদনা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৫ এর (ছ) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে- ‘তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে (point of sales) যে কোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।’ কেউ আইনের এ ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে তার তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডনীয় হবে।

তবে ইদানিং লক্ষ্য করা গেছে- তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিষয়ে কঠোর নজরদারি না করার কারণে তামাক কোম্পানিগুলো আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তামাকের দোকানগুলোসহ পুরো নগরীতে অবৈধ বিজ্ঞাপনে সয়লাব করে দিয়েছে। বিশেষ করে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর থেকে তামাক কোম্পানিগুলো নতুন আঙ্গিকে বিজ্ঞাপন ছড়িয়েছে।

‘জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল- জেটিআই’ ও ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ-বিএটিবি’ এবং ‘আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি’ তাদের অবৈধ বিজ্ঞাপনে এখন পুরো নগরী ছেয়ে দিয়েছে। ‘জেটিআই’ তাদের ‘শেখ’ প্রতি শলাকা ৫টা, ‘এলডি’ ৫ টাকা, ‘নেভি ৭ টাকা’- এমন বিজ্ঞাপনে পুরো নগরীর আনাচে-কানাচে সয়লাব করে দিয়েছে।

আবার ‘বিএটিবি’ বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছে ‘এখানে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি হয়। বেনসন প্রতি শলাকা ১৪ টাকা, গোল্ডলিফ ১০ টাকা, স্টার ৭ টাকা, রয়্যাল্স/ডার্বি ৫ টাকা। বিজ্ঞাপনের নিচে আবার লেখা রয়েছে- ‘নিরাপদ থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন’। আবার রাজশাহীতে কোম্পানিটির ডিস্ট্রিবিউটর মেসার্স আবুল হোসেনের পক্ষ থেকে কৌশলী এক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে।

এটির পক্ষ থেকে স্টিকারে একটি হটলাইন নম্বর ব্যবহার যে কোন অভিযোগ কিংবা পরামর্শের জন্য এই হটলাইন নম্বরে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। যা কোম্পানিটির একটি কৌশলী প্রচার-প্রচারণা।

এছাড়া আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছে “বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়লেও আপনার প্রিয় ব্র্যা- ‘মেরিস’ আগের দামে, একই উন্নত স্বাদে।” তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী এসব বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর বাজারে ‘এলডি’ ও ‘রয়্যালস’সহ বেশ কয়েকটি সিগারেটের ব্র্যান্ড নতুন এসেছে।

নতুন এসব ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যই তামাক কোম্পানিগুলো অভিনব উপায়ে অবৈধ বিজ্ঞাপন বাজারে ছড়াচ্ছে।

তামাক কোম্পানিগুলোর স্ট্র্যাটিজি হলো- আগের কোনো ব্র্যান্ডের বিভিন্ন সিগারেটের দামে নতুন ব্র্যান্ড তৈরী করে সেগুলো বাজারে ছেড়ে দেয়া। এর ফলে আগের দামে নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট দিয়ে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করাই তাদের উদ্দেশ্য। যার কারণেই কোম্পানিগুলোর এই অবৈধ বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি।

তবে আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি- কয়েক মাস আগেও তামাকের অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হতো। কিন্তু বেশ কয়েক মাস থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানিগুলোর নতুন নতুন এসব অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধে কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে না।

এছাড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে রয়েছে- বিক্রয় স্থলে তামাকপণ্যের প্যাকেট বা মোড়ক সাদৃশ্য কোন দ্রব্য, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে না।

এছাড়া তামাক ব্যবহারে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোনো উপহার, দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান আইনত দন্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের এই ধারা অমান্যকারীকে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে।

রাজশাহী মহানগরীর ৩০ টি ওয়ার্ডেই তামাকপণ্যের দোকান পরিদর্শনে দেখা গেছে, অধিকাংশ তামাকপণ্যের দোকানিকে তামাকপণ্য রাখার জন্য ‘নজরকারা’ শো-কেস উপহার দেয়া হয়েছে। আবার রাস্তার পাশে বেশ কিছু তামাকপণ্যের দোকানে উপহার দেয়া হয়েছে ছাতা। এছাড়া উপহার দেয়া হয়েছে টি-শার্ট, মগ, স্ট্রে, লাইটার ইত্যাদি। যা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের উপরের ধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ এবং দ-নীয় অপরাধ। অথচ আইনের এই ধারাটি বাস্তবায়নে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগে আমাদের চোখে পড়েনি।

তামাক কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্টরা এভাবে দেদারছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে চললেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে বতর্মানে দেশে তামাকজনিত কারণে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যুরোধ করা সম্ভব হবে না (তথ্যসূত্র: গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-গ্যাট্স ডাটা ২০১৭)।

বাস্তবায়িত হবে না ২০৪০ সালের মধ্যে ‘বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই স্বপ্ন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে এবং প্রধানমন্ত্রীর লালিত সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তামাকের অবৈধ বিজ্ঞাপন ও পুরস্কার প্রণোদনা বন্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাই রাজশাহী জেলা প্রশাসন অন্ততপক্ষে জেলায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে তামাকের এই অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধে জররি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি।

বার্তা প্রেরক: আমজাদ হোসেন শিমুল, মিডিয়া ম্যানেজার, এ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.