রাজশাহীতে ‘জলাধার বন্ধন’ কর্মসূচি পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলো সংরক্ষণের দাবি

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি: “একটি শহরের মোট ভূমির ১০ থেকে ১২ শতাংশ এলাকা জলাশয় ও ১৫ শতাংশ বনভুমি থাকা প্রয়োজন। রাজশাহীতে আশঙ্কাজনক হারে জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। বিপরীতে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের ভবন। গত ৫৯ বছরে রাজশাহীর জলাশয়ের প্রায় ৯৭ দশমিক ১৬ শতাংশ দখল ও ভরাট হয়েছে। ৯৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী শহরে ২.৮৪ শতাংশ জলাভূমি অবশিষ্ট রয়েছে।” এমনটায় বলেছেন জলাধার বন্ধন কর্মসূচির বক্তারা।
উন্নয়ন গবেষণাধর্মী যুব সংগঠন ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস, সবুজ সংহতি রাজশাহী মহানগর, পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদ, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম ও বারসিক যৌথভাবে সকল প্রাণের জন্য অভিঘাত সহনশীল, নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরী তৈরীতে রাজশাহীর সকল পুুকুর, জলাশয়, জলধারগুলো সংরক্ষণের দাবিতে আজ মঙ্গলবার (১১ জুন) বেলা ১১টায় রাজশাহী নগরীর সোনাদীঘি প্রাঙ্গনে জলাধার বন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে।
জলাধার বন্ধন কর্মসূচি শেষে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে সকল প্রাণের জন্য অভিঘাত সহনশীল, নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরী তৈরীতে রাজশাহীর সকল পুুকুর, জলাশয়, জলধারগুলো সংরক্ষণে ৯ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।
ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র সাধারণ সম্পাদক ও বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিকের সঞ্চালনায় জলাধার বন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, পর্যটনসহ নানাক্ষেত্রে পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলো একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পৃথিবীর মোট আহরিত মাছের দুই তৃতীয়াংশ আসে এসব পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলো থেকে। পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলো বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে, পানির রাসায়নিক উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে ও অতিরিক্ত পুষ্টি শোষণ করে পানির গুণাগুণ উন্নতকরণের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও খাদ্য উৎপাদনে, জলজ প্রাণীর বাসস্থান ও অতিথি পাখির আশ্রয়স্থল হিসেবেও পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশ দূষণ, জনসংখ্যার চাপ, বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনাসহ নানাবিধ কারণে দেশের পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোর প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন।
মূলত আইনের শিথিলতা ও প্রয়োগের অভাবেই বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহীসহ সারাদেশের পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোর পরিমাণ ক্রমশ কমছে। ফলস্বরূপ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমছে, তাতে ভারসাম্যহীন হচ্ছে পরিবেশ। রাজশাহীর সকল পুকুর, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল, ঝিল, লেক, জলাভূমি, প্লাবনভূমি, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধারের জোর দাবি জানান তারা।
ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র সভাপতি মো. শামীউল আলীম শাওন বলেন,“আমরা উন্নয়ন বিরোধী নই। আমরাও উন্নয়ন চাই। আমাদের কথা হলো পবিবেশবান্ধব ও টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলাশয়-জলাভূমি ও বনভূমিকে সুরক্ষা করে অভিঘাত সহনশীল, নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে হবে”। পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোকে সংরক্ষণ করা ও সেগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের দাবি করেন ইয়্যাস’র সভাপতি শামীউল।
পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহবায়ক মাহবুব টুংকু বলেন, “রাজশাহী একসময় ছিল পুকুরের নগরী। অথচ আজ সেই শহরকে প্রায় পুকুর শূন্য করে ফেলা হয়েছে। নগরীতে উন্নয়নের নামে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। পুকুর সংরক্ষণের নামে পুকুরগুলোকে চৌবাচ্চায় পরিনত করা হচ্ছে। কংক্রিটে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। পুকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করা হচ্ছে”। রাজশাহীকে বিদেশের আদলে নয় রাজশাহীকে রাজশাহীর মত করে গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।
সেভ দি ন্যাচার এন্ড লাইফ এর চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান বলেন, “এ নগরীকে যেভাবে কংক্রিটের আস্তরণ দিয়ে সাজানো হচ্ছে তাতে আগের সেই সবুজ শহর, পাখির শহর, পুকুরের শহরকে চেনা যাচ্ছে না। আমরা আগের সেই পরিবেশ বান্ধব পরিবেশ বন্ধব ও সকল প্রানের জন্য নিরাপদ, বাসযোগ্য রাজশাহী চাই”।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম বলেন, “আগে আমরা দীর্ঘ রাস্তা পায়ে হেঁটে স্কুল কলেজে যেতাম। তখন এত গরম লাগতো না। শরীর ঘামতো না। আজ ১০ ধাপ হাঁটতে গেলে হাসফাস ধরে যায়, শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়ে। এগুলো পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংশের পরিনাম। পরিবেশ প্রতিবেশ ও সবুজ সুরক্ষা করে উন্নয়ন করতে হবে। অনথ্যয় আগামীদিনে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ”।
আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি উপেন রবিদাস বলেন, “আমরা রাজশাহীকে নিয়ে গর্ব করি, আমাদের সেই গর্বের জায়গা যেন হারিয়ে না যায়। আজকের যে সোনাদিঘী এই সোনাদিঘীকে আগের সেই সোনাদিঘীতে পরিণত করা হোক, সোনাদিঘীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়া হোক”।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক নাদিম সিনা বলেন, “রাজশাহীর প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে রীতিমত ছেলে খেলা চলছে। নগরীতে গাছপালা, পাখি, জলাশয়, খেলার মাঠের একটা সুষম অবস্থান থাকবে। যার ফলে প্রত্যেকটি বৈচিত্র্য তারা তাদের নিজেদের মত জীবন নির্বাহ করবে”।
বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক বলেন, “শহরের মোট ভূমির ১০-১২ শতাংশ এলাকা জলাশয় ও ১৫ শতাংশ বনভুমি থাকা চাই। আর শহরে পাখি, প্রজাপতি মৌমাছি এবং জোনাকি দেখতে চাই”। উচ্চ আদালত কর্তৃক রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণসহ ৫ দফা নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি। সকল প্রাণের জন্য অভিঘাত সহনশীল, নিরাপদ, বাসযোগ্য নগরী তৈরিতে কর্মসূচি থেকে সবুজ সংহতির সদস্য সচিব নাজমুল হোসেন রাজু ৯ দফা দাবি উপস্থাপন করেন।
দাবিগুলো হলো – রাজশাহীর সকল পুকুর, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল, ঝিল, লেক, জলাভূমি, প্লাবনভূমি, বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার করতে হবে; ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করতে হবে; ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোর অধিগ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোর মালিকগণকে প্রণোদনা প্রদান করতে হবে; সংস্কার সংরক্ষণ, সৌন্দর্য্য বর্ধনের নামে পুকুর, জলাশয়, জলাধারগুলোর প্রকৃত আকার-আকৃতি বিনষ্ট ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে হবে; নগর পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধিকরণ এবং সৌন্দর্য বর্ধনে পুকুর, জলাশয়, জলাভূমিগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ ও নতুন পুকুর, জলাশয়, জলাভূমি সৃজন করতে হবে এবং বৈশি^ক মানদন্ড অনুযায়ী নগরে শহরের মোট ভূমির ১০ থেকে ১২ শতাংশ এলাকা জলাশয় ও ১৫ শতাংশ বনভুমি নিশ্চিত করতে হবে; পুকুর, জলাশয়, জলাভূমি ভরাট, দখল-দূষণ ও ভূমির (জলাভূমি) শ্রেণী পরিবর্তন কঠোরভাবে দমন করতে হবে; পুকুর, জলাশয়, জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করতে হবে; পুকুর, জলাশয়, জলাভূমি ভরাট বন্ধ করতে হবে; ইতোমধ্যে ভরাটকৃত পুকুর জলাশয়, জলাভূমি পুনরুদ্ধারসহ পুকুর, জলাশয়, জলাভূমির জীববৈচিত্র্য এবং প্রাণিসম্পদসহ পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; নগরায়নের ক্ষেত্রে সকল প্রাকৃতিক সম্পদ (পুকুর, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল, ঝিল, লেক, জলাভূমি, প্লাবনভূমি, বন ও জীববৈচিত্র্য) সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহার করতে হবে; প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০, জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং উচ্চ আদালত কর্তৃক রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণসহ ৫ দফা নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংবাদ প্রেরক আতিকুর রহমান আতিক, সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম, রাজশাহী। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.