রাজশাহীতে গণহত্যা ভয়াল ২৫ মার্চ : রাজশাহীর অনেক জনগণ আর ফিরলো না

নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্যান্য শহরের মত রাজশাহীতে গণহত্যা শুরু হয়েছিল আজ (২৫ মার্চ) রাতে। ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও যেসব ব্যাক্তিকে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় তারা আর কেউ ফিরে আসেননি।
ওঁরা হয়তো চিরকালই নিখোঁজের তালিকায় রয়ে যাবেন। নিখোঁজ মানুষ বেঁচে আছেন কিংবা মারা গেছেন তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ফিরে আসার ব্যাপারে একটা ক্ষীণ আশা থাকে নিকট জনদের মনে। তবে যতদিন যাবে ততই সে সম্ভাবনার দিকটি ম্লান হয়ে আসবে। কারণ কোনো জীবনই অবিনশ্বর নয়।
যাঁদের খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাঁরা দীর্ঘদিন থেকে নিরুদ্দেশ, তাঁদেরকেই আমরা নিখোঁজের তালিকায় রাখি। যেমন ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের অন্যতম নেতা সুভাষচন্দ্র বসু আজও নিখোঁজের তালিকায় আছেন।
নিখোঁজের তালিকায় আছেন: বাংলাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব জহির রায়হানও, যে স্বাধীন দেশে নিখোঁজ হন। যদিও এমন ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। একইভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে রাজশাহী শহরের ১১জনের বেশী ব্যক্তি আজও নিখোঁজ রয়েছেন। ওই নিখোঁজের ১১ ব্যক্তির মধ্যে ৫ জনই এক পরিবারের। আর ওই পরিবারটি হলো মরহুম আব্দুস সালামের পরিবার। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহরে ১২ জন বাঙালিকে হত্যা করে। এর মধ্যে ৩ জনের লাশ পাওয়া যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরীসহ মোট ৩ শহিদের পরিচয় পাওয়া যায় নি।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর যোহা হল ছিল তাদের টর্চার সেল।
অপরদিকে ১২ জনের বেশীর মধ্যে ৯ জন শহিদের পরিচয় মিললেও, লাশ মিলেনি। নগরীর বুলনপুর থেকে নিখোঁজ হন গিয়াস উদ্দিন,মনসুর রহমান প্রমুখ। যখন রাজশাহী শহরের মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত, নিরাপত্তা হারিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত, তখন অপরিচিত দু’জন ২৫ মার্চ সাহেববাজার এলাকায় শহিদ হন। টিকাপাড়া গোরস্থানে ২৬ মার্চে তাদের দাফন করা হয়।
অপারেশন সার্চলাইট পঁচিশ মার্চ রাত থেকে সারা দেশ জুড়ে পরিচালিত হয়েছিলো। রেশম নগরীখ্যাত রাজশাহীও তা থেকে বাদ পড়েনি। হত্যাযজ্ঞের শুরুতে একাত্তর পঁচিশ মার্চে ভয়াল কালরাতে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর জওয়ানরা রাজশাহী শহরে ১২ ব্যক্তিকে হত্যা করে। তার মধ্যে ৯ জনকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে। অপর একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী।
প্রতিদিনের মতো ২৫ মার্চ রাতেও রাজশাহীর ঐতিহাসিক ভুবনমোহন পার্কে মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতার চেতনাকে আরও শাণিত করার লক্ষ্যে দেশবরেণ্য মণীষীদের দেশপ্রেমমূলক রচনাসমূহ থেকে উদ্ধৃতিপাঠ, কবিতা আবৃত্তি ও গণসংগীতের আয়োজন করা হয়েছিলো। ওই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষ অংশে ‘রক্ত কথা বলে’ শীর্ষক একটি নাটকও মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি শেষ হয় আনুমানিক রাত সাড়ে ১১ টার দিকে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত ওই নাটকে পাকিস্তানি এক জেনারেল যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ভুবনমোহন পার্কের মঞ্চে জয়বংলা ধ্বনির মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
ঘটনাটি নাটকের বিষয় হলেও তা ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে যা যা ঘটেছে তারই যেন আগাম ধারাভাষ্য।
পঁচিশ মার্চ রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে রাজশাহীর উপশহরস্থ ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মি কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে রাজশাহী শহরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাদের তালিকাভুক্ত বিশিষ্ট লোকদের বাড়িতে হানা দিয়ে অনেককে ধরে নিয়ে যায়। তারা আর কেউ ফিরে আসেননি। সেদিন পাকিস্তানি আর্মির সাথে ছিলো বোরখাধারী লোক, যারা পাকসেনাদের তালিকাভুক্ত বাঙালিদের শনাক্ত করতে সহযোগিতা করে। বলা বাহুল্য, বোরখাধারীদের মধ্যে ছিলো পাকিস্তানিদের দালাল গুটি কয়েক বাঙালি এবং স্থানীয় অবাঙালি বিহারি সম্প্রদায়ের লোক।
অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম ছিলেন রাজশাহীর একজন প্রতিষ্ঠিত আয়কর আইনজীবী। আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে রাজশাহী শহরে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিলো। অথচ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলেন না। তবে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল সেদিন রাত সাড়ে ৩টায় সিপাইপাড়াস্থ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু সালাম সাহেব ওই মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তাঁকে না পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বড় ছেলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শহীদুজ্জামান সেলিম বাবু ও ছোট ছেলে রাজশাহী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ওয়াসিমুজ্জামানকে ধরে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি।
পাকিস্তানি আর্মির আর একটি দল রাত আনুমানিক ৪টায় চড়াও হয় লক্ষ্মীপুর ঝাউতলার একটি বাড়িতে। বাড়িটি তদানিন্তন রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান সাহেবের বাড়ি।
অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের ছোট ভাই তিনি। তাঁকে ধরার জন্য পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত বাড়িটিকে তচনচ করে খুঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু পাকসেনাদের আগমনের কিছুক্ষণ আগে মনিরুজ্জামান সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। তাই তাঁকে ধরতে না পারলেও ওই বাড়ি থেকে তাঁর ছোট ভগ্নিপতি পাকিস্তান শিল্প ব্যাংকের রিসার্চ অফিসার সাইদুর রহমান মিনা ও তাঁর ছোট ভাই বিশিষ্ট ঠিকাদার হাসানুজ্জামান খোকাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। হাসানুজ্জামান ছিলেন সেদিন ভুবন মোহন পাকে ‘রক্ত কথা বলে’ নাটক মঞ্চায়নের নেপথ্য নায়ক। যাহোক তাঁরা আর কেউ ফিরে আসেননি।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.