রাক্ষুসী মেঘনায় হারিয়ে যাচ্ছে হিজলা

বরিশাল ব্যুরো: সত্তোরোর্ধ সফুরা বেগম। যার চোখের সামনে হারিয়ে গেছে অর্ধশত কিলোমিটার জনপদ। ইতিপূর্বে তার পিতার বাড়ী ১৩ বার এবং স্বামীর বাড়ী মেঘনায় বিলীন হয়েছে ৯ বার। একই সময়ে তিনি তার এলাকার দুটি বাজারকে করালগ্রাসী মেঘনায় হারিয়ে যেতে দেখেছেন ৬ বার। সাথে ৮/১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা।

অসংখ্য মসজিদ ও মন্দির মেঘনায় তলিয়ে গেছে গত দুই যুগে। ভিটে-মাটি হারিয়ে নি:স্ব হয়েছে দুই গ্রামের দশ হাজারেরও বেশী বাসিন্দা। বর্তমানে তিন গ্রামের মানুষ একটি গ্রামে বস্তির ন্যায় বসতি গড়ে কোনো রকম বসবাস করছে। তারপরও তারা জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলছে মেঘনার সাথে।

সফুরা বেগম হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের গোড়দৌড় গ্রামের মৃত: শুক্কুর মাঝির মেয়ে। যাদের পূর্ব পুরুষদের ঘর-বাড়ী সহ পুরো গ্রামটি আশির দশকে চোখের পলকে দুইবছরের ব্যবধানে হারিয়ে যায় মেঘনা নদীতে।

সফুরার বাবা মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করেই সংসারের জীবিকা নির্বাহ করায় তাদের বসতি গড়তে হয় নদীর কাছাকাছি এলাকায়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শুক্কুর মাঝিকে ৮ বার ভাঙনের মুখে পড়ে নতুন করে বসতি গড়তে হয়েছে। সফুরার বাবা শুক্কুর মাঝি মারা যাবার পর তার দুই ভাইকে ৫ বার মেঘনার বিতারনে বসতি নিয়ে অন্যত্র ছুটতে হয়েছে। দুই যুগে মেঘনার সাথে লড়াই করে ইতিমধ্যে তারা তিন গ্রামের বাসিন্দা এবং তিনবার নতুন করে ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই যুগের মেঘনার ভাঙনে ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে বড়জালিয়া ইউনিয়নের গোড়দৌড় ও বাউশিয়া গ্রাম দুটি। বর্তমানে ওই দুই গ্রামের সিংহভাগ বাসিন্দারা বসবাস করছে বাহেরচর গ্রামে। তাও এখন মেঘনার মুখে। এই গ্রামটি ভাঙনের কবলে পড়লে ভিটে হারা হবে প্রায় অর্ধলাখ বাসিন্দা।

এছাড়াও হিজলা উপজেলার ধুলখোলা এবং হরিনাথপুর ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকার নদীতে বিলীন হয়েছে। এসব এলাকার বিস্তির্ন জনপদের সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হওয়ায় মানুষ যেমন হচ্ছে নি:স্ব, তার সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্মের শিশুরা।

এদিকে সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলের পানি মেঘনা নদীতে ঢুকতে শুরু করেছে। সেই সাথে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে হিজলা মেঘনা নদীতেও।
ইতিমধ্যে বেপরোয়াভাবে ভাঙ্গতে শুরু করছে মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন এলাকা। বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করে তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক গ্রাম। হিজলার মেঘনা পাড়ের সাধারণ মানুষের মনে সর্বদা আতংক বিরাজ করছে।

নদীর তীরে নেই বেঁড়িবাধ, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। যে টুকু আছে তাও কখন চোখের পলকে মেঘনার গর্ভে চলে যায় তা নিয়ে দু:চিন্তায় হাজার হাজার বাসিন্দা।

মেঘনায় পানি বৃদ্ধির ফলে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ধিরে ধিরে একের পর এক বাড়ি এখন বিলিন হচ্ছে নদী গর্ভে।

এদিকে মেঘনার ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে কিনা তা জানে না স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা পরিষদের খুব কাছে প্রমত্তা মেঘনা। সময় মতো মেঘনার ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে পাশ্ববর্তী জেলা শরিয়তপুরের “নড়িয়া উপজেলার” ন্যায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

বিগত বছরের ন্যায় এবারও মেঘনার মূল মোহনা পুরাতন হিজলা লঞ্চঘাট থেকে বাউশিয়া হয়ে মেহেন্দিগঞ্জের দড়িচর-খাজুরিয়া পর্যন্ত ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ভাঙ্গনের কারণে হিজলা উপজেলার মানচিত্র বদলে দিয়েছে প্রমত্তা মেঘনা।

বর্তমানে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জোয়ারের অতিরিক্ত পানি ধেয়ে আসায় আঘাত হানতে শুরু করেছে হিজলার মেঘনায়।
২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন বাউশিয়া স্থান পরিদর্শন করলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পুরাতন হিজলা লঞ্চ ঘাট এখন গাছে বাঁধা, একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দাড়িয়ে আছে মেঘনার পাড়ে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের ৫ একর জায়গার সিংহভাগ নদীগর্ভে বিলীন। প্রস্তাবিত হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ ফেরিঘাট-কোরবানের রাস্তার মাথার স্থাপনা এখন আর নেই।

বড়জালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ইউপি সদস্য মো. জুয়েল রাড়ী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, পুরাতন হিজলা বন্দর উপজেলার ঐতিহ্যবাহি একটি বাজার। ইতিপূর্বে বাজারটি ৩/৪বার মেঘনার ভাঙনের শিকার হয়েছে। গত দুইবছর পুর্বে বাজারটি অন্যত্র স্থাপন করা হয়েছে। সেটিও আজ হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত কাদাচ্ছে এই জনপদের মানুষগুলোকে।

পুরাতন হিজলা বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারের প্রধান শিক্ষক মাসুদুর রহমান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, আমার দেখা মতে বিদ্যালয়টি চারবার মেঘনার ভাঙনের কবলে পড়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টি অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে তিনি জানান।

হিজলা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল গাফফার বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, মেঘনা নদীর মুখে বিদ্যালয়টি। এ বছর ভবনটি থাকবে কিনা বলা মুশকিল।

অপরদিকে উপজেলা পরিষদ, নতুন হিজলা বাজার (টেক) এবং দক্ষিণ বাউশিয়া গ্রামের অবশিষ্ট চারের এক অংশও মেঘনার গ্রাসের মুখে। হুমকীর মুখে ওই এলাকার শতাধীক ঘর-বাড়ী। ইতোমধ্যে ১০/১২টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় রফিক খান, কাইয়ুম খান এখন নদীর মধ্যে বসবাস করছেন, কোথায় যাবেন তাও নিশ্চিত করতে পারছে না তারা।

তাদের অভিযোগ- জনপ্রতিনিধিরা তাদের পাশে নেই। পূর্ব পুরুষদের ভিটে-মাটি এখন স্মৃতি। সবকিছু রাক্ষুসি মেঘনার পেটে।
বড়জালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পন্ডিত শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, দুই যুগের অধিক সময় ধরে মেঘনায় বিলীন হচ্ছে এই জনপদ। ইতিপূর্বে হারিয়ে গেছে দুটি গ্রামের সকল কিছু।

বর্তমানে দক্ষিণ বাউশিয়া ও বাহেরচর গ্রাম দুটি মেঘনার হাত থেকে রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছি। উপজেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে যা মোটেও সম্ভব না। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে জরুরি পদক্ষেপের কথা জানিয়েছিলেন। তবে আশার বানী নিয়েই আমরা বছর পার করেছি, কাজের কিছুই হয়নি।

হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমীনুল ইসলাম বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, মেঘনায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে ভাঙ্গন দেখা দেয়ার কারণে উপজেলা সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে (এসিল্যান্ড) নির্দেশ দেয়া হয়েছে উপজেলার কোথায় কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপন করার জন্য। রিপোর্ট পেলে জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হবে।

এছাড়া উপজেলার নদী রক্ষা বাঁধ নির্মানের জন্য ৩৭৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রণয়নে কাজ চলমান রয়েছে। এই বিষয়ে সংসদ সদস্য এলাকায় আসলে তার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জল কুমার সেন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, আমরা হিজলা উপজেলাকে ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করার জন্য ৫শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহন করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করেছি। এছাড়া আপাতত আপদকালীন সময়ের জন্য ২ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকার কাজের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে ভাঙ্গন প্রতিরোধে কাজ শুরু হবে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বরিশাল ব্যুরো প্রধান আল মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.