রমযানঃ জরুরী কিছু মাসায়েল

নিজস্ব প্রতিবেদক: মুসলিম উম্মাহর এক অন্যতম আনন্দঘন মুহূর্ত হোল মাহে রমযান। ইসলামি সংস্কৃতির সুমহান নির্দেশনা এতে। মানব মনের কলুষতা মুক্ত জীবন ও গুনাহ মাফের অপার অনুগ্রহ এ মাস। বৈচিত্র্য ভেদে রোযা ফরজ (আবশ্যক) ছিল এক আল্লাহতে বিশ্বাসী প্রতিটি উম্মাহর (জাতি) উপরে। আল্লাহ তা’আলা বলেন (1)يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا الَّذِينَ كُتِبَ عَلَى مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿البقرة: ١٨٣
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। (২: ১৮৩)
পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের এ মাস পেয়েও যারা পরিবর্তন হতে পারলনা তাদের ধ্বংস অনিবার্য। রাসুল সঃ বলেন “ যে রমযান মাস পেল অথচ তার গুনাহ মাফ করে নিতে পারলনা সে ধ্বংস হোক।” (বোখারি,আল আদাবুল মুফরাদ-৬৪৬)

দেখা যায় আমরা অনেকি রমযান মাস পেয়েছি এবং গুনাহ মাফের প্রস্তুতিও নিচ্ছি কিন্তু না জানার কারনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুল করে ফেলছি। তাই সাধারন পাঠকদের উদ্দেশে কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসায়েল বর্ণনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।

০১। চাঁদ দেখে রোযা রাখা ও ছাড়াঃ-

নিজ ভূখণ্ডের মধ্য থেকে নিজে অথবা বিশ্বাসযোগ্য কোন একজন মুসলিমের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দানের মাধ্যমে রোযা রাখতে হবে এবং ছাড়তে হবে। (বোখারি-১৯০০)

উল্লেখ্য যে, ইদানীং কালে কিছু ফেতনার আবির্ভাব হয়েছে যে, সওদি আরবের সাথে রোযা রাখবে এবং ঈদ করবে। যে ব্যাপারে তাদের খোঁড়া যুক্তি শরীয়তের দলিলের কাছে মোটেই টেকেনা। বরং নিজ ভূখণ্ডের ব্যাপারে স্পষ্ট দলীল বিদ্যমান। ( মুসলিম- ১০৭৮,আশরাহুল মুমতে ৬ এর ৩২১-৩২২ আল উসাইমেন)

০২। নিয়ত ছাড়া রোযা হবেনাঃ-
সেহেরী খাওয়ার পূর্বেই নিয়ত করতে হবে নচেৎ রোযা রাখলেও তা আদায় হবেনা বরং কাজা আদায় করতে হবে। তবে হ্যাঁ রমযান মাসে নিয়ত না করে কেও রোযা রাখলে তার সে দিনের রোযা হবেনা বটে কিন্তু সারাদিন রমজানের সন্মানারথে কিছু খাওয়াও যাবেনা। (সহিহ আত তিরমিজি- ৭৩০)

জ্ঞাতব্য যে, নিয়ত মানে সংকল্প। মনের মধ্যে ধারনা থাকলেই চলে। মুখে আরবি কিম্বা বাংলায় কোন কিছু উচ্চারণের প্রয়োজন নাই।

০৩। সাহারিঃ-
দ্রুত ও বিলম্বে খাওয়া অভয়টাই সুন্নত। ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হওয়া পর্যন্ত এর শেষ সময়। ( কুরআনঃ২-১৮৭, বুখারি-৫৫২)

হাতে খাবার প্লেট অথবা ঘুম থেকে এমন সময় উঠেছে যখন আজান দিচ্ছে, তখনো পেট পূর্ণ করে খাবে এতে দোষ নেই। (আবু দাউদ ২৩৫০, বায়হাকি ৪-২১৮ সহিহ)

ঘুম থেকে দেরিতে উঠার পর জানা গেলো আজান হয়ে গেছে, তখন আর খাওয়ার সুযোগ নেই। কেও আজানের পর খেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে, কাজা আদায় করতে হবে, তবে সারা দিন কিছু খাবেনা।

সামান্য কিছু হলেও সাহারিতে খেতে হবে। নচেৎ রোযা হবেনা। তবে অসুস্ততা বা অজ্ঞাতসারে না খেলেও রোযা পূর্ণ হবে ভাঙ্গা যাবেনা। ( মুসলিম ১৯৬)

রাতে যে কোন কারনে অপবিত্র হয়ে গেলে সে অবস্থায়ও সাহারি খাওয়া জায়েজ আছে। তবে সাহারির পরে হলেও যথাদ্রুত পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম। ( মুসলিম ১১১০)

০৪। ইফতারিঃ-
ইফতারি দ্রুত করাই উত্তম অথচ আমাদের সমাজে এক ধরনের প্রচলন আছে যে, ইফতারিতে সময়ের পরেও হাতে ৫ মিঃ সময় রাখা এবং সাহারিতে সময়ের ৫মিঃ পূর্বেই আজান দেওয়া। যা একধরনের বিদআত (শরীয়তে নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার। বিদআতে অভ্যস্তরা জান্নাতে প্রবেশ করবেনা। সহিহ মুসলিম ৮৬৭) বুখারি-১৮৫৬

প্রথমে খেজুর ও পানি দিয়ে রোযা ছাড়াটাই উত্তম। (আবু দাউদ ২৩৫৭ সহিহ)

কিছুই না পারলে বিসমিল্লাহ বলে খানা শুরু করবে। পারলে নিম্নক্ত দোআ পাঠ করবে
« ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ ».
“পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।” [সুনান আবূ-দাউদ: ২৩৫৯, সহীহ]
অপর বর্ণনায় যে এসেছে
«اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ »


“হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।” [সুনান আবু দাউদ :২৩৫৮] আমল যোগ্য – আলবানী।

০৫। তারাবীহঃ-
২০ রাকাত এবং বিতের সহ ২৩। অথবা ৮ রাকাত এবং বিতের সহ ১১। উভয়টাই জায়েজ যা সহিহ রেওয়াতে ( সুত্রে) বর্ণীত। তবে রাসুল সঃ এবং সাহাবায়ে কেরাম এই ছলাতটি দীর্ঘ সময় নিয়ে আদায় করতেন। কখনো রাকাত সংখ্যা কমিয়ে অথবা বারিয়ে (বুখারি ৯৯০,১১৪৭)

অথচ এনিয়ে আমাদের সমাজে যা ঘটে তা সত্যিই দুঃখ জনক। জ্ঞানের স্বল্পতা এবং গোঁড়ামি ছাড়া বৈ কি।

মহিলারাও এই ছলাতে পুরুষদের পিছনে জামায়াতে অংশ নিতে পারবে। আলাদা জামাত করতেও দোষের কিছু নাই। তাদের মধ্য থেকেই একজন ইমাম হবেন, যিনি কিনা তাদের কাতারেই দাঁড়াবেন পুরুষদের মতো সামনে দারাবে না।

উল্লেখ্য যে পুরুষ ও মহিলার ছলাতে এতটুকুই পার্থক্য । অন্যকোন পার্থক্য বলে সমাজে যা প্রচলিত আছে তা সম্পূর্ণই বিদআত।
আল্লাহ পাক আমাদের সঠিক পথ দান করুক, আমীন।

০৬। অবশ্যই রোযা রাখতে হবে যাদেরঃ –
মুসলিমঃ অমুসলিমদের উপর রোযা ফরজ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। তবে পূর্ণ আস্তাশীল অর্থাৎ কেও যদি নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে, তাহলে অবশ্যই তাকে রোযা রাখতে হবে। নচেৎ সে হবে জাহান্নামি। এমনকি তার জানাজা এবং মুসলমানের কবরে তার জায়গা হবেনা। ( রমযানের ফাজায়েল ও রোযার মাসায়েল ৪৫ পৃঃ , সহিহ তারগিব- আলবানী ৯৯১, ফাতওয়ায়ে তাইমিয়া ২৫/২২৫)

বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্কঃ মুসলিম তবে বালেগ না হলে রোযা ফরজ না। এজন্য মুসলিম হওয়ার পাশাপাশি রোযা ফরজ হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হোল, ব্যক্তিকে অবশ্যই বালেগ হতে হবে। তবে অপ্রাপ্ত ছোট শিশুরা রোযা রাখলে কল্যাণ প্রাপ্ত হবে এবং এর জন্য তার বাবা-মা অধিক কল্যাণ প্রাপ্ত হবে। ( মুসলিম ১১৩৫)

উল্লেখ্য যে, যে কোন ক্ষেত্রে বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হবে- (ক) ব্যক্তির বয়স সাধারণত ১৫ অথবা ১৬ হবে। (খ) নাভির নিচে লোম গজাবে। (গ) উত্তেজনা ভাব বা বীর্য আসবে, স্বপ্নদোষ বা মেয়েদের হায়েজ শুরু হবে। আরও জ্ঞাতব্য যে, ‘খ’ ও ‘গ’ পরিস্ফুটিত হলে বয়স ধর্তব্য না। ( আশরাহুল মুমতে ৬/ ৩৩৩)

জ্ঞানবানঃ পাগলের উপর রোযা ফরজ নয়। জ্ঞান সম্পূর্ণ ব্যক্তিরাই রোযা রাখবে। তবে হয়ত দেখা গেলো পাগল রোযার মাসে রাতেই সুস্থ হয়ে গেলো তাহলে অবশ্যই সে পরদিন রোযা রাখবে। আর যদি দিনের কোন এক সময় সুস্থ হয় তাহলে দিনের বাকী সময় রমযানের সন্মানারথে কিছু খাবেনা।

০৭। রমযানে রোযা না রেখে অন্যমাসে কাজা আদায় করতে পারবে যারাঃ – 

অসুস্থ ব্যক্তিঃ ধর্মপ্রাণ মুসলিম ডাক্তারের পরামর্শে রোযা ছাড়া বা ভাঙ্গা যাবে। কোন রকম কাফফারা ( অতিরিক্ত জরিমানা ) ছারাই অন্য মাসে কাজা আদায় করা যাবে। (আল কুরআন ২/১৮৪)

উল্লেখ্য যে, সুস্থ তবে এমন বৃদ্ধ যে রোযা রাখলে শারীরিক দুর্বলতা বেরে যায় এ কারনে সে রোযা রাখতে অনিচ্চুক। তখন সে ফিদিয়া ( অন্যকে খাদ্য খাওয়ানো) দিয়ে দিলেই হবে। আর খাদ্য দেওয়ার নিয়ম এই যে, নিজে যা খান এমন খাদ্য অথবা সে পরিমান অর্থ প্রতি রোযার জন্য একজনকে দিয়ে দিবেন। অথবা ত্রিশ দিন পর একবারে একজনকে বা ত্রিশ জনের মাঝেও বিলাতে পারেন। ( আল কুরআন ২/১৮৪,বুখারি ৪৫০৫)

ভ্রমণকারীঃ অবৈধ কোন উদ্দেশ্য ব্যতিত যে কোন প্রয়জনে সফররত অবস্থায় রোযা কাজা করা যাবে। তবে সফরের সংজ্ঞা কি ?
এ ক্ষেত্রে বিদ্বানদের নিকট থেকে দুটি মত উল্লেখযোগ্য – ক) ৩ দিনের বেশি ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য ৪৮ মাইল দূরে অবস্থান করবে। খ) সময় বা দুরুত্তের নির্ধারিত কোন সীমা রেখা নাই।

আমার গবেষণা মূলক দৃষ্টিতে ( সেটা ভুলও হতে পারে আবার শুদ্ধও হতে পারে অল্লাহু আ’লাম) তিন দিনের বেশি আবার ১৫ দিনের কমের কথাটিও যেমন সঠিক মনে হয়না, অন্যদিকে ৪৮ মাইল বা কোন ধরাবাঁধা দুরুত্ত কেও যারা অস্বীকার করছেন সেটাও মানতে পারিনা।
আমার মতে কোন অস্থায়ি উদ্দেশে নিজ আবাসিক এলাকা ছেড়ে ৪৮ মাইল বা ৮০ কিলো দুরুত্তে গিয়ে ফিরে আসার সময়টাই সফর। হোক সেটা ১ দিন বা ১ বৎসর। আবার যদি স্থায়ি বসবাসের নিয়ত করে নিজ এলাকা ছেড়ে ৪৮ কেন ৯৬ মাইল দুরুত্তেও যাই সেটা সফর নয়। ( আব্দুল্লাহ ইবনে বাজ ‘মাজমুয়া আল ফাতুয়া’১২/২৬৭, ফিকহুস ছিয়াম ৪৯)

যেমন ধরুন, আমি আমার অফিসিয়াল কোন কাজে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় আসলাম। কাজটি একদিনেই সারার মতো অথচ আমলা তান্ত্রিক জটিলতায় ফাইল আর নরেনা। এতে করে এক মাস কেটে গেলো। আশাকরি আমি অবশ্যই সফরের সব সুযোগ ভোগ করতে পারব।
আবার ধরুন, আমার অনার্স বা মাস্টার্স কোর্সটি শেষ করার জন্য মুটামুটি স্থায়ি বসবাসের নিয়তে ঢাকায় আসলাম। তা অবশ্যই সফরের মধ্যে পরবেনা।
তবে জ্ঞাতব্য যে, সফরের সুযোগ ভোগ করা না করা সম্পূর্ণই সফর কারীর স্বাধীনতা। (মুসলিম ১১১)

শুধুই নারীঃ উপরোল্লিখিত অবস্থা ছাড়াও নারীর আলাদা কিছু কারন বিদ্যমান। নিম্নে উল্লেখ করছি –

ক) নিফাসঃ এক্ষেত্রে সবাই একমত যে, বাচ্চা প্রসব করার পর ৪০ দিন নিফাসের সময়। আর এই সময়ে রোযা নামায সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে রোযার কাজা আদায় করতে হবে আর নামায পুরাই মাফ সুবহানাল্লাহ ! যদি ৪০ দিনের পরেও নিফাস বন্ধ না হয় তাহলে সেটা ইস্তেহাজা (রোগ) ধরতে হবে।

আর ইস্তেহাজার বিধান হোল এটা এক ধরনের রোগ এর জন্য ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া প্রয়জন। এই সময় নিজেকে পবিত্রই মনে করতে হবে। তাই তখন পবিত্রতার সাথে ছলাত ও ছিয়াম উভয়টাই আদায় করতে হবে। কাপরে লেগে থাকলে হয় ধুয়ে পরিষ্কার করবে নয়তো কাপর পালটাবে।

আবার যদি ৪০ বা ৪২ দিন পর মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হয় তাহলে হায়েজের বিধানই প্রযোজ্য হবে।

খ) দুগ্ধপোষ্য শিশুঃ দুগ্ধপোষ্য শিশুর কোন সমস্যার আশংকা থাকলে।

ঘ) হায়েজঃ মাসিক ঋতুস্রাব মহিলাদের একটি নিয়মিত ব্যাপার। এ নিয়ে অনেক মাস’আলা বিদ্যমান। এখানে কেবল গুরুত্বপূর্ণ দুই একটি বিষয় আলোচনা হবে। হায়েজের সময়, চিহ্ন ইত্যাদি নিয়ে বিদ্বানদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। সর্বপরি তিনটি প্রসিধ্য মত উল্লেখযোগ্য। যার প্রতিটির পিছনেই দলিল প্রসিদ্ধ এবং অকাট্য। তাই কোন একটিকে প্রাধান্য না দিয়ে নিম্নে তিনটিকেই উল্লেখ করছি।

১) সর্বনিম্ন ১/৩ দিন সর্বচ্চ ১০/১৫ দিন। এর কম বা বেশি হলে ইস্তেহাজাহ (রোগ)।
( হেদায়া- ইমাম আবু হানিফা, আহমদ, মালেক, শাফেয়ী সহ অনেকেই)

২) সাধারনত প্রতি মাসে যে কয়দিন হয় সে কয়দিনই হায়েজ। কোন মাসে কম বেশি হলে তা ইস্তেহাজা। ( সহিহ নামায শিক্ষা- আব্দুল্লাহ ইবনে ফজল রহঃ )

৩) নির্ধারিত কোন সময় নেই। ১ দিনও হতে পারে ১০ দিনও হতে পারে। মাসে ১ বার হতে পারে, ২/৩ বারও হতে পারে। আবার কোন মাসে স্থায়িত্ব ৫ দিনও হতে পারে ১০ দিনও হতে পারে। মূলকথা হোল এই মতের প্রবক্তাদের মতে এর নির্ধারিত কোন কিছু নাই। বরং এর কিছু চিহ্ন দেখে নির্ণয় করতে হবে। যেমনঃ –

রং – হায়েজের রক্ত কালচে আর ইস্তেহাজার রক্ত লাল।
ঘনত্ব- হায়েজের রক্ত গারো বা ঘন আর ইস্তেহাজা পাতলা।
গন্ধ – হায়েজের রক্ত দুর্গন্ধ যুক্ত। ইস্তেহাজায় গন্ধ নেই কারন এটা শিরার স্বাভাবিক রক্ত।
জমাট বদ্ধতা- হায়েজ জমাট বাধে না। ইস্তেহাজা জমাট বাধে।
(নির্বাচিত ফতওয়া -০১ “ সিয়াম সংখ্যা” আত থবাত লাইব্রেরী, সউদি)

উপর উল্লেখিত চিহ্নের আলোকে নারী তার হায়েজ এবং ইস্তেহাজা, বা পবিত্রতা এবং অপবিত্রতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে নিজেকেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তা এভাবেও হতে পারে, যেমনটি নবী পত্নী গণ বা তখনকার সলেহিন মহিলারা করত। আর তা হলো গুপ্তাঙ্গে সাদা তুলা দেবে, পরে বের করে চিহ্ন দেখে সঠিক অবস্থা নির্ণয় করবে। ( মুয়াত্তায়ে মালিক ১৩০)

তবে হ্যাঁ, যদি এমন হয় যে হায়েজের পর সাদা স্রাব আসছে অর্থাৎ পবিত্র হয়ে গেলো, অতঃপর আবার ভিন্ন রঙ্গয়ের বা হায়েজের মতো স্রাব আসলো তখন কিন্তু সেটাকে হায়েজ ধরা যাবেনা। সেটা ইস্তেহাজা। ( বুখারি ৩২০)

বিধানঃ –
রোযা রাখবেনা অন্য সময় কাজা করবে। দিনের বেলা পবিত্র হলে ইফতারি পর্যন্ত কিছু খাবেনা। সেহেরির পূর্বে পবিত্র হলে রোযা শুরু করবে। আগামি কাল থেকে হায়েজ শুরু হবে ভেবে, কেও রোযা থেকে বিরত থাকবেনা। আবার আগামি কাল পবিত্র হতে পারি ভেবে, হায়েজ অবস্থায় রোযা শুরু করবে না। অর্থাৎ অগ্রিম ধারনা বশত কিছু করা যাবেনা যদিও তা ঠিক হয়। পবিত্র–অপবিত্রতার বিষয়টা পূর্ণ দৃষ্টি গোছর না হওয়া পর্যন্ত রোযা রাখা বা ছাড়া যাবে না। সেহেরী খেয়ে রোযা শুরু করেছে অথচ দিনে হায়েজ শুরু হোল, তখন রোযা ছেড়ে দেবে।

০৮। যে কাজায় কাফফারা ওয়াজিবঃ- 
নারী পুরুষ যে কেও যদি ইচ্ছাকৃত যে কোন উপায়ে ( খেয়ে, সহবাস করে, বীর্যপাত ঘটিয়ে ইত্যাদি) রোযা ভঙ্গ করে, তাহলে তার উপর কাজা আদায়ের সাথে সাথে কাফফারাও আদায় করতে হবে।
আর কাফফারা আদায়ের বিধান হোল একটি রোযার জন্য (ক) একজন দাস মুক্ত করা, তা না পারলে (খ) টানা ৬০ দিন রোযা রাখা। একদিন মিস হলে পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। অথবা (গ) ৬০ জন মিসকিন কে খাওয়াতে হবে। ( কুরআন ৫৮/ ৩-৪)

স্ত্রী যদি স্ব ইচ্চায় সহবাস করে তাহলে স্বামীর অনুরূপ কাফফারা। আর যদি স্বামী বাধ্য করে তাহলে স্বামীর কাফফারা, স্ত্রীর শুধু কাজা আদায় করতে হবে। ( ফাতওআ আল লাজমাহ আদ দাইমাহ ১০/ ৩০২)

০৯। যে কারনে রোযা ভাঙ্গেঃ – 
খাওয়া, বীর্যপাত, সহবাস, হায়েজ, নিফাস, ইচ্ছাকৃত বমি করা, দূষিত রক্ত বের করা, নিয়ত বাতিল করা, মুরতাদ হয়ে যাওয়া, বেহুশ হওয়া।

জ্ঞাতব্য যে কেও কেও মনে করেন স্বপ্ন দোষের কারনে রোযা ভাঙ্গে অথচ তা ঠিক নয়। কেননা ঘুমের মধ্যে যা ঘটে একারণে ব্যক্তি দায়ী নয়। ( ফিখহুস ছিয়াম, ড মাঞ্জুরে ইলাহি সম্পাদিত ৬৭ পৃষ্ঠা)

১০। যে কাজ রোযাকে হালকা করেঃ – 
এমন কিছু কাজ আছে যা রোযাকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেবেনা বটে, রোযাকে হালকা করে। বিদ্বান গণ বলেন একাজ গুলো রোযাকে নষ্ট করার দার প্রান্তে নিয়ে যায়। তাই এগুলো থেকে হেফাজত থাকাই শ্রেয়। যেমন-

মুখ ভোরে ছ্যাপ গিলা, লেগে থাকা খাদ্য পরিষ্কার না করা, কোন কিছুর ঘ্রান নেওয়া, কোন কিছু চিবান, স্ত্রীর সাথে এমন আচরণ করা যে যৌন ক্ষুধা জাগ্রত হয়, তুথ পেস্ট বা পাওদার ব্যবহার করা, কুলি করা বা নাকে পানি নেয়াতে অতিরঞ্জিত করা। ( আহকামুস ছাওমি অল ইতেকাফ- আবু সারি ১৬২,১৬৩ পৃষ্ঠা)

এছাড়াও এমন কিছু কাজ আছে যা আসলে রোযার বাহিরেও নিষেধ, রোযার ভিতরে আরও মারাত্মক। কারন রাসুল সঃ বলেন যে ব্যক্তি রোযা থেকেও খারাপ কাজ গুলো ছাড়তে পারল না তার রোযার দরকার নেই। যেমন-
মিথ্যা বলা, ঝগড়া করা, গিবত করা ইত্যাদি যত খারাপ কাজ আছে। ( বুখারি ৬০৫৭)

১১। মনে হয় রোযা ভাঙ্গবে অথচ যা বৈধঃ –
এমন কিছু কাজ আছে যা বাহ্যিক দৃশটিতে রোযা ভাঙ্গার কারন বলে মনে হতে পারে। এমনকি অজ্ঞতা বসত কেও কেও এসব নিয়ে বিতর্কেও লিপ্ত হয়। অথচ এগুলো রোযা নষ্ট করবে না। যেমন-

মেসওয়াক করা, আঁতর বা সুগন্ধি ব্যবহার, সুরমা লাগানো, চোখ কান নাক এমন কী মল দারেও ঔষধ লাগানো, চিকিৎসায় পেটে ণল ঢুকান (নলের মধে খাদ্য না দিয়ে), স্বামী স্ত্রীর চূম্বণ ( যদি উত্তেজনা না হয়), রক্ত বের হওয়া, রক্ত দেওয়া, দাত তোলা, কিডনি পরিষ্কার, ইনজেকশন, মাথা নেরে করা, নখ কাতা, ক্রিম লাগান, তরকারি টেস্ট করা, স্বাভাবিক থুথু গিলা, দিনে ঘুমান, ইফতার থেকে সাহারি পর্যন্ত খাওয়া এবং সহবাস করা, দিনে ঘুমান, পবিত্রতা চাড়াই সিহেরি খাওয়া এবং পরে পবিত্র হওয়া ইত্যাদি।
(ইর ইয়াউল গালিল- সহিহ, আলবানী ১ এর ১০৬, ইবনে জিব্রিন ২এর ১২৭, মুসলিম ১১০৬, ইবনে বাজ- ফাতয়া মুহিম্মাহ ইত্যাদি)

উল্লেখ্য যে রোযা ভঙ্গের কারন শুধু উপরে ৭,৮,৯ নং এ যা উল্লেখ করা হয়েছে তাই।

১২। ২৭ শে রমযান সবে কদর নয়ঃ –
সবে কদর নিশ্চয় অত্তান্ত ফজিলত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের সমাজে একধরনের বিভ্রান্ত রয়েছে। আমরা মনে করি তা শুধুই ২৭ শে রমযান। এবং এব্যাপারে অনেক যুক্তিও দেওয়া হয় যা সত্যি নিন্দনীয়, সুন্নাহর খেলাপ। রাসুল সঃ এটা স্পষ্ট করেছেন যে, যারা এই ফজিলত পূর্ণ রাত পেতে চায় তারা যেন ২১ – ২৯ পর্যন্ত প্রতিটি বেজর রাতে ইবাদতে নিমগ্ন হয়। (বুখারি ২০১৫)

উল্লেখ্য যে, রমযানের শেষ দশক অন্য দিন গুলো থেকে এমনিতেও অধিক মূল্যবান। এই দিন গুলতে বাকী বিশ দিনের তুলনায় অধিক হারে জাহান্নামিকে খমা করা হয় । ( বুখারি ১৯২০)

আরও জ্ঞাতব্য যে, এ রাত গুলতে অধিক ফজিলত অন্বেষণে অপবিত্র ( হায়েজ- নিফাস) নারিরাও জাগ্রত থেকে তসবি তাহলিল, দোআ দরুদ ইত্যাদি করে কাটাতে পারবে। ( ফাতউয়ায়ে রামাদান -২, সওদি আরব)

১৩। ইতেকাফঃ – 
ইতেকাফ করা সুন্নাত। তবে কেও মানত করলে ওয়াজিব হয়ে যাবে।
রমযানে অথবা অন্য সমায়েও করা যায়। রাসুল সঃ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন।
নারিরাও মসজিদে গিয়ে ইতেকাফ করতে পারবে।
বিনা কারনে মসজিদ থেকে বের হওয়া, আজগুবি গল্প গুজব, সহবাস, এবং হায়েজ- নিফাসে ইতেকাফ ভঙ্গ হবে।
অন্য সময়ে ইতেকাফের কাজা আদায় করা যাবে।
( রমযানের ফাজায়েল ও রোযার মাসায়েল, আব্দুল হামিদ ফাইজি , বাংলা ১৯০ পৃষ্ঠা)

১৪। ছদাকাতুল ফিতরঃ – 
রোযায় তুটা ফাটা ভুলের বিশুদ্ধতা এবং ইদের আনন্দে গরিবের মুখে হাসি ফুটানই এর উদ্দেশ্য।
গরিব ধনি, চোট বড় এমনকি ইদের দিনে সদ্যজাত শিশুর পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করতে হবে।
(রমযানের ফাজায়েল ও রোযার মাসায়েল, আব্দুল হামিদ ফাইজি , বাংলা ১৯০ পৃষ্ঠা)
গরিবের থেকে নিয়ে বেশি করে ফিরে দিতে হবে।
(রমযানের ফাজায়েল ও রোযার মাসায়েল, আব্দুল হামিদ ফাইজি ১১২ পৃষ্ঠা, বাংলা)


১৫। ঈদ মুবারকঃ
গোসল করা, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া এবং মাঠে যাওয়ার পূর্বে কিছু খাওয়া এ দিনের সুন্নাত।
সাজসজ্জা, সুগন্ধি লাগান, শুভেচ্ছা বিনিময়, ধনি গরিব একসাথে আনন্দ করা ইদের অন্যতম সুন্নাত।
মুবারকবাদ দেওয়া, উইশ করা, এসএমএস দেওয়া ইত্তাদিও সুন্নাত ( অবশ্যই অপাত্রে নয়)।
নারী ও শিশুরাও ইদের মাঠে যাবে। এমনকি অপবিত্র নারিরাও। তবে তারা ছলাত আদায় করবে না, দোয়ায় শরিক হবে।
( সিলসিলাহ সহিহা- আলবানী ১২৭৯, ইর উয়াউল গালিল, বুখারি ৩২৪)

১৬। আরও ৬ টি রজাঃ – 
রমযানের পর পরই সাওয়াল মাসে আরও ৬ টি রোযা রাখা অধিক কল্যাণ।
রমযানের একেকটি ১০ এবং এই ছয় টিকেও ১০ দিয়ে গুন করে ( ৩৬ * ১০ = ৩৬০ দিন) পূর্ণ বৎসরের শোয়াব লিখা হয়।
রমযানের কাজা থাকলে আগে সেটা আদায়ই উত্তম।
( মুসলিম ১১৬৪, রমযানের ফাজায়েল ও রোযার মাসায়েল, আব্দুল হামিদ ফাইজি ২৮১ পৃষ্ঠা, বাংলা) #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.