রমজান মাসের ইতিহাস ও রোযার ব্যাখ্যা

সারা বিশ্বজুড়ে মুসলিমের কাছে রমজান মাস একটি পবিত্র সময়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রেখে তারা এ সময়টি পার করে থাকে। কিন্তু ইসলামের পূর্বে রোজা কেমন ছিল? কবে প্রথম এই মাসব্যাপী রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়?  এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

রামাদান [رمضان] (ভাষাগত অপভ্রংশ: রমজান) শব্দটা এসেছে আরবি মূল রামিদাবা আর-রামাদ থেকে, যার মানে প্রচণ্ড উত্তাপ কিংবা শুষ্কতা। আরবি ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। ৬১০ সালের রমজান মাসেই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ওহীর মাধ্যমে নবুয়ত পেয়েছিলেন । এ মাসের যে রাত্রিতে প্রথম আয়াতগুলো নাজিল হয় (সুরা আলাক এর প্রথম পাঁচ আয়াত) সে রাতকে বলা হয় শবে কদর বা লাইলাতুল কদর  (আরবিতে লাইল=রাত) । বলা হয়েছে যে, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত্রির কোনো এক রাত্রি এই শবে কদর, প্রসিদ্ধমতে সেটা ২৭ তারিখ ধরে নেয়া হয়। যদিও আরেক মতে সেটি ২৩তম রাত্রি। তবে নিশ্চিতভাবে এই রাতটি পাবার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ইতিকাফ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্জনে টানা ১০ দিন  ইবাদত। আর এই রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর যা মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবের একটি।

মক্কা শরিফ, সৌদি আরব

পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও, মতবাদ আছে যে, নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সহিফা নাজিল হয়েছিল তৎকালীন রমজানের ১ম দিবসে, তাওরাত এসেছিল ৬ রমজান, যাবুর ১২ রমজান আর ইঞ্জিল ১৩ রমজান। যদিও আরবের বাহিরে রমজান মাস হিসেব করা হতো না, কিন্তু এই হিসেবটা ভিন্নজাতিক পঞ্জিকার সাথে মিলিয়ে স্থির করা হয়েছে বলে বলা হয়।

তবে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং সাহাবীরা মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।

“রমযান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে।” [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:185]

মসজিদে নববী, মদিনা, সৌদি আরব

তবে এমন না যে, এর আগে কেউ রোজা রাখত না। অবশ্যই রাখত। কুরআনেই বলা রয়েছে যে, আগের জাতিগুলোর জন্যও রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সেটা রমজান না হলেও।

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:183]

এমনকি মক্কার মানুষেরাও ইসলামের পূর্বে রোজা রাখত, তবে সেটা কেবল মুহাররাম মাসের ১০ম দিন, আশুরার রোজা। কারবালার ঘটনা তখনও ঘটেনি, আশুরার প্রধান উপজীব্য ছিল হযরত মুসা (আ) এর নেতৃত্বে মিসর থেকে বনী ইসরাইলের মুক্তি এবং লোহিত সাগর দু’ভাগ হয়ে যাবার ঘটনা। আত্মসংযম আর আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির নিমিত্তে অন্যরাও রোজা রাখত বটে।

মসজিদে নববী, মদিনা, সৌদি আরব

৭৪৭ সালের একজন আরব লেখক আবু যানাদ জানান যে, উত্তর ইরাকের আল জাজিরা অঞ্চলে অন্তত একটি মান্দাইন সমাজ ইসলাম গ্রহণের আগেও রমজানে রোজা রাখত। প্রথম থেকেই রমজানের রোজা রাখা শুরু হত নতুন চাঁদ দেখবার মাধ্যমে, তাই অঞ্চল ভেদে রোজার শুরুও ভিন্ন হতো। এখন মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি দেশের মুসলিমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক সময়ানুসারে সেখানে রোজা রাখতে পারে না, যেহেতু সেখানে দিনরাত্রির পার্থক্য করা দুরূহ। তাই নিকটতম স্বাভাবিক দেশের সময়সূচী কিংবা মক্কার সময় মেনে তারা রোজা রাখে এবং ভাঙে।

অতিরিক্ত ইবাদত হিসেবে রয়েছে তারাবিহ, যদিও সেটি বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) প্রথমদিকে জামাতের সাথে সে নামাজ আদায় করলেও পরে জামাতে করেন নি, পাছে সেটি মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। তবে খলিফা উমার (রা) পুনরায় জামাতে আদায় করা শুরু করেন তার শাসনামলে। তবে শিয়াগণ তারাবিকে নবউদ্ভাবন বলে পরিত্যাগ করে থাকে। আট থেকে ২০ রাকাত পর্যন্ত তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে, তবে মক্কার হারাম শরিফে ২০ রাকাতই আদায় করা হয়। উল্লেখ্য, ফজরের ওয়াক্ত হবার পূর্বে খেয়ে রোজা রাখাকে সাহরি আর সূর্যাস্তের পর খেয়ে রোজা ভাঙাকে ইফতার বলা হয়।

সৌদি আরবে তারাবির নামাজ পড়ানো হচ্ছে

 মুহাম্মাদ (সা) যখন মদিনা এলেন, তখন তিনি দেখলেন ইহুদীরা আশুরার রোজা রাখছে। যদিও তারা ইসরায়েলে থাকতে ইহুদী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত, সেখানকার ইহুদী মাস তিশ্রির দশম দিবসে তারা রোজা রাখত (ইয়ম কিপুর)। আরবে তারা সেটার সাথে মিলিয়ে মুহাররামের দশম দিন আশুরার দিন রোজা রাখত। হযরত মুহাম্মাদ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তারা কেন রোজা রাখে? তারা উত্তর করল, এদিন আল্লাহ্‌ বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেছিলেন এবং হযরত মুসা (আ) এজন্য রোজা রেখেছিলেন। তখন হযরত মুহাম্মাদ (স) মুসলিমদেরও এ রোজা রাখতে নির্দেশ দেন যেহেতু হযরত মুসা (আ) ইসলাম ধর্মেও নবী। তবে তিনি সাথে অন্তত একদিন অতিরিক্ত রাখতে বললেন, আগের দিন কিংবা পরের দিন। পেছনের কাহিনী মক্কাবাসীরা না জানলেও, তারা ঠিকই আগে থেকে এ দিন রোজা রাখত, এমনকি ইসলামের আগে হযরত মুহাম্মাদ (স) নিজেও রেখেছিলেন।রমজানের রোজা বাধ্যতামূলক হবার আগে এ রোজাটা সবাইকে রাখতে হত। রমজানের রোজা আসবার পর এ রোজা নফল হয়ে যায়।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ) এবং তাঁদের উম্মাতগণ সকলেই সাওম পালন করেছেন।নবীগণের মধ্যে হযরত দাউদ (আ)-এর রোযা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আমর ইব্‌নুল আস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সবসময় রোযা রাখ এবং রাতভর নামায আদায় কর। আমি বললাম জী, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তুমি এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। যে ব্যক্তি সারা বছর রোযা রাখল সে যেন রোযাই রাখল না। (প্রতি মাসে) তিনদিন রোযা রাখা সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশি রাখার সামর্থ রাখি। তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি ‘সাওমে দাউদী’ পালন কর। তিনি একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন। ( ফলে তিনি দর্বল হতেন না ) এবং যখন তিনি শত্রুর  সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না।

এতে প্রমাণিত হয়যে, হয়রত দাউদ (আ) – ও সিয়াম পালন করেছেন। মোটকথা হয়রত আদম (আ)- এর যুগ থেকেই রোযা রাখার বিধান ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আদর্শচ্যুত হয়ে লোকেরা আল্লাহর বিভিন্ন বিধানকে যেভাবে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছিল অনরূপভাবে রোযার মধ্যে তারা এমন সব পরিবর্ত ন করেছিল যাতে রোযার ধর্মীহয় তাৎপর্যয ও বৈশিষ্ট শেষ হয়ে একটি নিছক প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

এহেন অবস্থা হতে রোযাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং এক আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে মহান রাব্বুল আলামীন দ্বিতীয় হিজরীতে রমযান মাসের রোযাকে এ উম্মাতের উপর ফরয করে দেন।

“হে ইমানদারগণ ! তোমাদের জন্যায সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো যেমন বিধান তোমাদের পূর্বনবর্তী ীদেরকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাক্‌ওয়া হাসিল করতে পার [পবিত্র কুরআন, বাকারা 2:18৩]

 

মদিনায় ইফতার বিলি

অনেকের আগ্রহের বিষয় থাকতে পারে, নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও সাহাবীরা কী খেয়ে সাহরি বা ইফতার করতেন? নবীজী (সা) মাগরিবের আগে কয়েকটি ভেজা খেজুর খেতেন, তা না থাকলে শুকনো খুরমা/খেজুর, আর পানি। এটাই ছিল ইফতার। একবার তিনি সফরে থাকা অবস্থায় ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার করেছিলেন। সাহরি ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন খেজুরকে। তবে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে খেজুরগুলো ছোট ছোট, আরবীয় খেজুর যথেষ্ট বড়, অন্তত আমাদের দেশের তুলনায়।

আরবীয় খেজুর

সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ রমজান মাসটি পালন করে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে, এবং পরম আগ্রহে সাদরে বরণ করে নেয় রমজান শেষে ঈদকে। সবাইকে রামাদান মোবারাক!

রমজান মোবারাক

তথ্যসূত্র

  • পবিত্র কুরআন, মুসলিম শরীফ, ১০৯৯, বায়হাকি, মেশকাত : ১৭৪, নাসায়ি: ২১৬২, আবু দাউদ, ২৩৪৫, বুখারি শরিফ (সাওম অধ্যায়), মুসলিম শরিফ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.