রক্তে আগুন ধরানো ভাষণ ছড়িয়ে আছে সবখানে

নিজস্ব প্রতিবেদক: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’ আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণকালের এক সেরা ভাষণে বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।… আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দিবে।’
এই ঘোষণার মর্মবাণী এবং এই নির্দেশের তাৎপর্য বাঙালি জাতির কাছে অস্পষ্ট ছিল না। সে কারণেই ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলার সাথে সাথেই সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ান, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা তথা গোটা জাতি একযোগে রুখে দাঁড়িয়ে দুর্জয় প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা করে।
রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়াদী উদ্যান) আওয়ামী লীগ আহূত জনসভায় অগ্নিঝরা ভাষণে জনসমুদ্র আন্দোলিত হচ্ছিল। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়া লক্ষ লক্ষ জনতার কণ্ঠে একই আওয়াজ স্বাধীনতার বজ্র শপথ।
খুব সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার লোক ঢাকায় আসতে শুরু করে। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন, আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিবেন। তাই জনসভায় যোগ দিতে মানুষ ঢাকায় জমায়েত হতে থাকলো।
সারা শহরে যেন প্রাণের মহোৎসব। উদ্যম গতিময় আর সৃজনী শক্তিতে আত্মপ্রত্যয়ী বাঙালি ছুটছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। স্লোগানের শাণিত উচ্চারণ বাঙালি ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসছে। আর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা নয়-এবার চাই অধিকার, চাই স্বাধীনতা।
দুপুর ১২টার মধ্যেই লক্ষ লক্ষ লোক জমা হয়ে গেল রেসকোর্সের মাঠে। সমুদ্র তরঙ্গের মত আঁছড়ে পড়ছে জনতার ঢেউ। লক্ষ কণ্ঠে একই আওয়াজ। ফাল্গুনের উদ্যম হাওয়ায় পত্ পত্ করে উড়ছে বাংলাদেশের সোনালী মানচিত্র অংকিত সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা। লক্ষ লক্ষ বাঁশের লাঠি বাঙালির সংগ্রামের আত্মপ্রত্যয়ী প্রতিকী ব্যঞ্জনায় স্লােগানের ছন্দে ছন্দে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে।
বঙ্গবন্ধু মুজিব মঞ্চে আরোহণ করলেন ৩-২০ মিনিটে। বজ্র নিনাদে কেঁপে কেঁপে উঠলো দশ-দিগন্ত। দশ লক্ষ মানুষের সম্মিলিত কন্ঠস্বর। স্লোগানের ভাষা ছিল : জয় বাংলা; আপোষ না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম; আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ; পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ; ষড়যন্ত্রের পরিষদে বঙ্গবন্ধু যাবেন না; ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল ইত্যকার নানা স্লােগান।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সব বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ প্রচারের ঘোষণা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সরকার তা বাতিল করেন। বেতার ভবনে একদল সৈন্য সঙ্গীনের মুখে ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা বানচাল করে দিল। বিক্ষুব্ধ বেতার কর্মীরা ঢাকা স্টেশন ত্যাগ করে জনসভায় চলে আসেন। বেতার কর্মীরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করে নিয়েছিলেন।
সামরিক জান্তা প্রস্তুত ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা দিলে রক্তের বন্যা বইয়ে দেবার জন্য। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সৈন্যরা যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সভাস্থল তাক করে গোলন্দাজ বাহিনী কামানগুলা বসান হয়েছিল। গোলা বর্ষণের নির্দেশ দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে থাকে। ইয়াহিয়া খান অজুহাত খুঁজছিলেন-একটু উস্কানি পেলেই আঘাত হানবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত দিলেন না। তিনি সহিংস আন্দোলনের ধারা বজায় রেখে ভাষণ দিলেন। তিনি ১৮ মিনিট বক্তৃতা করেন। এটি ছিল তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠতম বক্তৃতা। তাঁর চোখে-মুখে ফুটেছিল বজ্রের কঠোরতা ও ইস্পাতের দৃঢ়তা। ঢাকা বেতার ৭ মার্চ বিকেলে যে স্তব্ধ হল তা আর রাতে চালু হতে পারেনি।
পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড এদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ৩২ নম্বরের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এটি ছিল স্বল্পকালীন গোপন বৈঠক। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এই বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিস্কার ভাষায় ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। এই সিদ্ধান্ত হচ্ছে “পূর্ব বাংলায় স্ব-ঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি মোঃ মাইনুর রহমান (মিন্টু) রাজশাহী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.