রংপুরে অবৈধভাবে তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকারক স্টিয়ারিক এসিডের মোমবাতি : বাড়ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি

রংপুর ব্যুরো: রংপুরমহানগরীসহ আশেপাশের উপজেলাগুলোতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে শতাধিক মোমবাতি তৈরির কারখানা। সরকারের সকল নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে এবং শুল্ক ও দাম কম হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিকারক স্টিয়ারিক এসিড দিয়ে এসব কারখানায় দেদারছে মোমবাতি তৈরি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। চিকিত্সকরা বলেছেন, এসব মোমবাতি ব্যবহার করে ক্যান্সারসহ নানান ধরনের জীবন বিনাশী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনগন। পাশাপাশি সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব।

মোমবাতির জীবনরহস্য:

উকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মোমবাতি আলোর একটি উত্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো একে তাপের উৎস হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এটি জ্বালানির (সাধারণত মোম) একটি কঠিন টুকরোয় তৈরি এবং এর ভেতরের একটি সলতের মাধ্যমে জ্বলতে থাকে। মোম প্যারাফিন থেকে তৈরি করা হয়। এছাড়াও মোমবাতি মৌমাছির শরীর-নিঃসৃত মোম, সয়াবিন এবং অন্যান্য উদ্ভিজ্জ মোম, পশুর শক্ত চর্বি থেকে তৈরি হয়। জেল মোমবাতি প্যারাফিন ও প্লাস্টিকের মিশ্রণ থেকে তৈরি হয়।দিয়াশলাই কাঠির তাপ দিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর সময় মোমের কিছু অংশ গলে যায় এবং জ্বালানির অতি সামান্য অংশ বাষ্পীভূত করে দেয়। বাষ্পীভবন হয়ে গেলে জ্বালানি বাতাসের অক্সিজেনের সাথে মিশে শিখা তৈরি করে।

এই শিখাই মোমবাতির পরবর্তী অংশটুকু জ্বালিয়ে রাখবার জন্যে প্রয়োজনীয় তাপ তৈরি করে: শিখাটির তাপ মোমবাতির ওপরের কঠিন অংশটুকু গলিয়ে ফেলে, তারপর তরল মোম সলতে বেয়ে কৈশিকতার দরুন ওপরে উঠে যায় আর বাষ্পীভূত হয়ে অক্সিজেন সহযোগে পুড়ে শিখাটিকে প্রজ্জলিত রাখে। জ্বালানির দহন কয়েকটি পৃথক অংশে ঘটে থাকে ( মোমের শিখার বিভিন্ন অংশে রং এর পার্থক্য থেকে বলা যায়)। নীল অংশে দহনযোগ্য জ্বালানি থেকে হাইড্রোজেন পৃথক হয় এবং পুড়ে গিয়ে পানি বাষ্প তৈরি করে। উজ্জ্বল, হলুদ অংশটুকুতে কার্বন পুড়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। পরবতীতে ধীরে ধীরে মোমবাতির কঠিন অংশটুকু গলতে থাকে, আর মোমের দৈর্ঘ্যও ছোট হতে থাকে। সলতের যে অংশে তরল মোম বাষ্পীভূত হয় না তা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সলতের এই ভস্মীভবনের মাধ্যমে এর অতিরিক্ত দৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রিত হয়, যা দহনের তাপমাত্রা এবং জ্বালানি ব্যয় একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধরে রাখে। আবার কোন কোন সলতে ছেঁটে দিয়ে সুস্থির শিখাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়।

দেশে বিদ্যমান বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারনে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই মোমবাতির আলো নির্ভর হয়ে উঠে রংপুর অঞ্চলের মানুষ। একসময় শুধু শহরের মানুষ মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোর চাহিদা পূরণ করলেও এখন কেরোসিনে ভেজাল ও দাম বেশী হওয়ায় গ্রামের মানুষও মোমবাতির উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মোমবাতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান মোমবাতির এই চাহিদার কারনেই ঢাকার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলোর মোমবাতি ছাড়াও রংপুরেও বৈধ ও অবৈধভাবে মোমবাতির কারখানা গড়ে উঠেছে।

প্রাপ্ত তথ্য ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রংপুর মহানগরীর স্টেশন এলাকা, পাল পাড়া, নিউ জুম্মাপাড়া, সিওবাজার, হুনমানতলা, তাজহাট, সাতমাথা এবং পীরগাছা, কাউনিয়া, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও মিঠাপুকুর উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে উঠেছে এই অবৈধ মোমবাতির ছোটবড় অর্ধশতাধিক কারখানা। সব থেকে আতংকের ব্যাপার হচ্ছে রংপুরে এসব মোমবাতি ব্যবহার করে মানুষ ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এ দাবী বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের।

সরেজমিনে দেখা গেছে এসব কারখানায় মোমবাতি তৈরির অন্যতম উপকরণ প্যারাফিন ওয়াক্স ব্যবহার করা হচ্ছে না। প্যরাফিন ওয়াক্সের শুল্ক কর ২৫ ভাগ হওয়ায় কারখানার মালিকরা তা ব্যবহার করছেন না বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। প্যারাফিন ওয়াক্সের বদলে এসব কারখানায় রাবার মসৃণ করার রাসায়নিক কেমিকেল স্টিয়ারিক এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ করে। মোমবাতির প্যাকেটের গায়ে এই এসিডের পরিমান উল্লেখ করা হচ্ছে না।

কেমিষ্টরা জানিয়েছেন, স্টিয়ারিক এসিড ব্যবহারের ফলে মোমবাতি কম গলে, ধোয়া দেখা যায় না এবং আলো বেশী হয়। ফলে এই তিনটিকে চুম্বক গ্যারান্টি হিসেবে জাহির করে এসব কারখানার উত্পাদিত মোমবাতি বাজারজাত করা হচ্ছে অনায়াসেই। সচেতনতার অভাবে সাধারন মানুষ তা ক্রয় করছেন দেদারছে। কিন্তু এসব মোমবাতির আলোর কারনে মানুষ ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ধররের জীবন বিনাশী রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিবেশের ওপর পড়ছে মারাত্বক বিরুপ প্রভাব।

বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ টিকিত্সক ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী উদ্বেগ প্রকাশ করা তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, স্টিয়ারিক এসিড দিয়ে তৈরি উত্পাদিত মোমবাতি মূলত: একধরনের এসিড মোমবাতি। ১০ ভাগের বেশী স্টিয়ারিক এসিড দিয়ে তৈরি মোমবাতির আলোতে প্রতিদিন একঘন্টা করে কাজ করলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এছাড়াও আ্যজমা বা হাপানি, ব্রংকাইটিস, অন্ত্রের প্রদাহ, চোখের ক্ষত, দৃষ্টি শক্তি হ্রাস, নাকের ক্ষত, ত্বকের প্রদাহ ও দেহের বিভিন্ন অংশে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

রংপুর বিসিক, আয়কর ও কর অফিস সূত্রে জানা গেছে, এসব কারখানার কোন ফাইল তাদের দপ্তরে নেই। অথচ তারা লাখ লাখ টাকার মোমবাতি তৈরি করে অবাধে বাজারজাত করছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেখা গেছে স্থাণীয় ভাবে উত্পাদিত এসব মোমবাতির প্যাকেটে কোন ট্রেড নম্বর নেই। নেই মাননিয়ন্ত্রন সম্পর্কিত বি এস টি আইয়ের কোন তথ্য। উত্পাদন উপকরণের ব্যাপারেও কোন তথ্য নেই প্যাকেটের গায়ে। প্রস্তুতকারক হিসেবে রংপুরের ঠিকানাও নেই। সুন্দর করে প্যাকেটের উপরে লেখা আছে, চায়না থেকে আমাদীনকৃত ও চাঁদের মত আলো হয় এবং গলে না।

অনেক সময় ঢাকার প্রতিষ্ঠিত মোমবাতির অনুকরণে প্যাকেট জাত করে ঢাকার কোম্পানীর দামেই এসব মোমবাতি রংপুরে বিক্রি করছে এসব অসাধূ ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে রংপুরে এসব স্বাস্থ্য হানিকর অবৈধ মোমবাতি তৈরি করে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করা হলেও সরকারী কোষাগারে এই খাত থেকে একটি টাকাও রাজস্ব জমা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

প্রকৃত উদ্যোক্তারা মনে করেন, এসব কারনে তারা রংপুরে মোমবাতি তৈরির কোন বৈধ বৃহত্ কারখানা তৈরি করতে পারছেন না। অথচ এরকম বড় বড় বৈধ কারখানা গড়ে উঠেলে স্থায়ী ভাবে এখানে শত শত মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সরকার পাবে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব।

এ প্রসঙ্গে রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন বিটিসি নিউজকে জানান, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অদুরদর্শিতা ও মনিটরিং অভাবের কারনেই মারাত্বকভাবে স্বাহ্যহানিকর এসব মোমবাতি কারখানা গড়ে উঠেছেন। এসব কারখানাকে আইনের আওতায় না আনতে পারলে তা হবে চরম উদ্বেগের কারন। একই সাথে তিনি এরকম বৈধ কারখানা বৈধভাবে গড়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহবান জানান।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোরশেদ আলম বিটিসি নিউজকে জানান, একদিকে অবৈধ অন্যদিকে ওপর জীবন বিনাশী রোগের ব্যাধির কারন এসব কারখানায় ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহন করে তাদেরকে আইনের হাতে সোপর্দ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রকৃত উদ্যোক্তা ও আগ্রহীদেরকে এমন কারখানা তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের স্থায়ী পদ সৃষ্টি করে এই অঞ্চলের সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়া জরুরী। এতে বেকার যুবক যুবতীদের চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সার্বিক বিষয়ে রংপুরের ডেপুটি কমিশনার এনামুল হাবীব বিটিসি নিউজকে জানান, অবৈধভাবে গড়ে উঠা স্বাস্থ্য হানিকর মোমবাতি কারখানার ব্যপারে শীঘ্রই তদন্ত সাপেক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রংপুর ব্যুরো প্রধান সরকার মাজহারুল মান্নান।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.