যুগের পরম্পরায়‘কলি যুগ’


লেখক: ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত: সময় মানব জীবনের এক মূল্যবানমাত্রা, যাঅতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয় আপন রহস্যময়তায়। মানুষের মূল্য, সম্ভাবনা ও সক্ষমতা সময় কেন্দ্রিক। একটি নির্দ্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে প্রতিটি মানুষই আবার ফিরে আসেপূর্বের রূপে। আবর্তিত সময়ের অসংখ্য এককের মাঝে ‘যুগ’ একটি। যুগ নিয়ে তাই যুগ যুগ ধরে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।
রবি ঠাকুরের ‘বহু কোটি যুগ পরে’, শামসুর রাহমানের ‘তিন যুগ পর’ কবিতাতেই নয় বরং ‘হায়রে কলি কালে বাবা দিল বিয়ে’ গান থেকে শুরু করে সাধু ও বোদ্ধাদের যুগধর্মের মর্মবাণী অহর্নিশ অনুরণিত করে মনকে জামানার পর জামানা। তাই তো সাধারণ মানুষের মুখে যখন শুনি, ‘কি আর করবে বাপু, এটা যে কলি যুগ!’ তখন অবাক হওয়ার কিছুই থাকে না।
আধুনিক সময়ের যুগ চক্রে,‘স্বামী শ্রীযুক্তেশ^র গিরি’ ও ‘আলেন ড্যানিয়েল’ এঁর মতে পৃথিবীতে-সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ. দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ নামে চারটি যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়। স্মৃতিশাস্ত্র ও সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে বিভিন্ন যুগ পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের স্বকীয় সংস্কৃতিতে। চারটি যুগের মধ্যে সত্য যুগ হলো প্রথম যুগ। এই যুগে ধর্মের চারটি পাদ বিদ্যমান ছিল অর্থাৎ চার ভাগই ছিল পুণ্য, কোন পাপ ছিল না।
ত্রেতা হলো চারটি যুগের দ্বিতীয় যুগ; এ যুগে তিন ভাগ পুণ্য, এক ভাগ পাপ বিদ্যমান ছিল। তৃতীয় যুগ হিসেবে অর্ধেক পুণ্য ও অর্ধেক পাপ নিয়ে পরিচিত ছিল দ্বাপর যুগ। চার যুগের শেষ যুগ হলো কলি যুগ। এই যুগে সত্য যুগে বিদ্যমান ধর্মের চার পাদ হতে ত্রিপাদ হীন হয়ে এক পাদ অবশিষ্ট থাকবে অর্থাৎ এক ভাগ পুণ্য, তিন ভাগ পাপবিরাজমান থাকবে; পৃথিবীতে ধর্ম সংকুচিত হয়ে অধর্মের আধিক্য ঘটবে।
পাষান্ড, আচারহীন, দুশ্চরিত্র, মিথ্যাবাদী, অপরাধী ও ভাঁওতাবাজ ইত্যাদি লোকের প্রভাব অত্যন্ত বাড়বে এবং এরা দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হবে এবং সজ্জনেরা নিরন্তর কষ্ট, যন্ত্রণা, দুঃখ ও ক্লেশ ভোগ করবে।মানুষ স্বল্প আয়ু নিয়ে জন্মাবে, মানুষ তপস্যাহীন হয়ে যাবে, সত্য থেকে দূরে অবস্থান করবে; রাজনীতি হবে কুটিল; শাসক হবে ধনলোভী; সাধু হবে শাস্ত্রহীন; পুরুষ হবে স্ত্রীর অনুগত; দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং জ্ঞানীরা মর্যাদা হারাবে।
“ঋষি মার্কগুয়ের” কলি যুগের মানব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন: কলি যুগে মানুষের প্রধান গুণ হবে- লোভ ও ক্রোধ। মানুষেরা একে অপরের সাথে প্রকাশ্যে ঘৃণা প্রদর্শন করবে; অহেতুক ঝগড়া-বিবাদ ও খুনে জড়াবে কিন্তু অপরাধ বোধ থাকবে না। অবৈধ অর্থ ও যৌন সংসর্গকে জীবনের কেন্দ্রীয় প্রয়োজন হিসেবে দেখবে।
সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন সংকুচিত হয়ে পড়বে; মাতাপিতা ও সন্তান সন্ততির মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হবে। বয়স্ক, গুরু, শিক্ষক ও মাতাপিতার প্রতি অসম্মান, অবজ্ঞা ও অবহেলা বাড়বে এবং তাঁদের সাথে মানুষ শত্রæভাব পোষণ করবে।
কলি যুগের ব্যপ্তি এতটাই বৃহৎ ও বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক, যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোকপাত করাআর আকাশ কুসুম ভাবনা একই কথা বৈকি! সংগত কারণেইশিরোনামের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি গল্প দিয়ে এ লেখার যবনিকাপাত করতে চাই। ছোটবেলায় দাদার কাছ থেকে শোনা ‘কলি যুগ’ সম্পর্কিত এই গল্পটির মাধ্যমেই চারটি যুগ সম্পর্কে সব প্রথম আমার ধারণা জন্মে। গল্পের শুরুতে, এক বিধবা অনাথ শিশু সন্তান নিয়ে গ্রামের একমন্ডলেরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন কাজের বিনিময়ে জীবিকার তাগিদে।বিধবার প্রয়াত স্বামীর রেখে যাওয়া কিছু টাকা তিনি নিরাপদ মনে করে মালিকের কাছে আমানত রাখলেন।
অনেক দিন পর সন্তান বড় হলে সন্তানের পরামর্শক্রমে বিধবা মালিকের কাছে তার গচ্ছিত ‘অন্ধের যষ্ঠি’ ফেরত চাইলেন। মালিক অস্বীকার করলেন এবং মিথ্যা অপবাদে বিধবাকে হেয় করলেন।নিরুপায় বিধবা অনেক কান্নাকাটি করে অবশেষে গ্রামের লোকের কাছে বিচার দিলেন। বিচারে কোন সাক্ষী না থাকায় গ্রামের লোকজন বিধবাকে মিথ্যুক প্রমাণ করলেন এই যুক্তিতে যে, তার যদি এতগুলো টাকাই থাকবে তাহলে এতদিন আমরা জানলাম না কেন? কেউ যুক্তি দিল, যদি তার টাকাই থাকতো তাহলে এতদিন ‘ও’ বাড়িতে কাজ করবে কোন দুঃখে! বিচারে বিধবা দোষী সাব্যস্ত হলে অনুনয়ের স্বরেবললেন আমার কথা যদি মিথ্যে হয় তাহলে আমার সন্তান যেন এই মুহুর্তে মারা যায়; বলা মাত্র বিধবা ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। অদৃষ্টের কি পরিহাস! সংগে সংগে তার ছেলে মারা গেল! সবাই বিধবাকে ভৎসনা করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
বিধবা দুঃখে শোকে সত্যের পরাজয় মেনে নিয়ে গ্রামের পাশে এক গভীর জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিলেন এবং অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলেন। বিধবার কান্না শুনে গভীর রজনীতে এক অদৃশ্য দূত হাজির হলেন; সবকিছু শুনে তিনি বললেন, সবই বুঝতে পারছি কিন্তু আমার করার কিছুই নেই, কারণ আমি সত্য যুগের প্রতিনিধি, আমার কর্তৃত্ব এ পৃথিবীতে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, তুমি বরং অপেক্ষা কর এরপর যিনি আসবেন তার সাথে কথা বলো। এই বলেসত্য যুগের দূত বিদায় নিলেন। পরবর্তীতে এক এক করে ত্রেতা যুগ ও দ্বাপর যুগের দূত এলেন এবং সত্য যুগের মতো তারাও একই কথা ও উপদেশ দিয়ে বিদায় নিলেন। অবশেষে এলেন কলি যুগের প্রতিনিধি; সব কথা শুনে বিধবাকে আশ^স্ত করলেন এবং ব্যবস্থাপত্র দিয়ে তিনিও বিদায় নিলেন। তাঁর উপদেশে বিধবা ভয়ে শিহরে উঠলেন!কিন্তু নিরুপায়! এছাড়া অন্য পথ কোথায়?
কলি যুগের দূতের পরামর্শ মোতাবেক বিধবা সকল সংশয় দূরে ঠেলে আবার মৃত সন্তানকে নিয়ে গ্রামে ফিরেএলেন এবং অনেক কষ্টের বিনিময়ে লোকজনকে একত্রিত করে কলি যুগের প্রতিনিধির দেওয়া বক্তব্য পেশ করলেন। তাঁর বক্তব্য শুনে সবাই বিধবার ওপর চটে গেলেন এবং মারতে উদ্যত হলেন। বিধবা শান্ত ও ধীরস্থির ভঙ্গিমায় সকলকে সম্বোধন করে ঘোষণা করলেন: আমি ভয়ে ভয়ে কম টাকার কথা বলেছিলাম, সত্য কথা এই যে, আমি যে টাকার কথা বলেছি মূলত তার দ্বিগুণ টাকা মালিকের কাছ থেকে পাব। এই বলে সন্তানের মাথায় হাত দিতেই মৃত সন্তান জীবিত হয়ে উঠল!
গ্রামের মন্ডলের কী হয়েছিল জানা নেই;তবে বিধবা ফিরে পেয়েছিলেন তার দাবীকৃত সমুদয় অর্থ। সাময়িক লাভবান হয়েও সত্য ও মিথ্যার কারিশমা অবলোকন করে‘কলি যুগকে’ ধন্যবাদ দিবে না-কি ঘৃণা করবে বিধবা তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারলেন না; অদৃশ্য এক অপ্রাপ্তি যেন গ্রাস করল তাঁর সমস্ত প্রাপ্তিকে!মিথ্যা যেন কলি যুগের সকল অপকর্ম সংঘটনের বিশ^স্ত হাতিয়ারে পরিণত হলো!চারিদিকে মিথ্যা যেভাবে সবকিছুকে নির্লজ্জের মতো নিয়ন্ত্রণ করছে, শঙ্কা রয়েই যায় আমরা,“কলি যুগে” নেই তো?
সংবাদ প্রেরক লেখক: ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত, শিক্ষা কর্মী, মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.