যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক, কতটুকু উপকৃত হবে ভিয়েতনাম

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত লি কং ফুং ২০১১ সালে ওয়াশিংটনে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন হ্যানয় ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ স্থাপন করবে। তার ঐ ঘোষণার পর এক যুগ পার হয়ে গেলেও দুই দেশের উচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।
কৌশলগত অংশীদারিত্ব বলতে কী বোঝায় এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক মহলে কোনো তৎপরতাই দেখা যায়নি। ২০১৩ সালে অবশ্য দুদেশের মধ্যে সর্বাত্মক অংশীদারিত্বের একটি ঘোষণা আসে। যদিও কূটনীতিকদের মতে, এটি কৌশলগত অংশীদারিত্বের চেয়ে নিচু পর্যায়ের সহযোগিতা কিন্তু সেটাও যেন কথার কথার মতোই থেকে গেল। কোনো পক্ষকেই এ নিয়ে অগ্রসর হতে দেখা গেল না।
এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দুটো সরকার পার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বর্তমান প্রশাসন মনে করছে যে, এ ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। কারণ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আধিপত্য রুখে দেওয়ার মধ্যে দুদেশেরই অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে।
২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন যে ইন্টারিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজিক গাইডেন্স তৈরি করে তাতে ভিয়েতনামকে সিঙ্গাপুরের সমপর্যায়ে রাখা হয়েছে। গত বছর বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে ভারত, তাইওয়ান ও নিউজিল্যান্ডের মতো ভিয়েতনামকে ‘লিডিং রিজিওনাল পার্টনারের’ পর্যায়ে রাখা হয়েছে।
এ বছর মার্চে বাইডেন ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট নগুয়েন ফু ট্রংয়ের এর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এর পরপরই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিঙ্কেন ভিয়েতনাম সফর করেন। এ সফরকালে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ নয়, শুধু শক্তিশালী হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, খুব শিগিগরই দুদেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের স্তরে পৌঁছাবে। সম্ভবত জুলাইতে ট্রংয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় সেই ঘোষণা আসতে পারে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, কৌশলগত অংশীদারিত্ব একটি কূটনৈতিক পরিভাষা মাত্র। এর ফলে দুই দেশের অফিসিয়াল সম্পর্কে বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার বিপরীতে এটি একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। এটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভিয়েতনামকে এগিয়ে রাখবে। প্রতীকী হলেও চীনের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়।
ভিয়েতনামে চীনের আগ্রাসন চালানোর ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সব সময়ই হবে তা নয়। তবে চীনের এই প্রবাদটি ভিয়েতনাম নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখবে যে, ‘দূরের পানি দিয়ে কাছের আগুন নেভান যায় না’। ভিয়েতনাম দূরের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে চীনের মোকাবিলায় নিজের সুরক্ষা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
ভিয়েতনামে চীনা আগ্রাসনের জেরে যে যুদ্ধ হয় তা ১৯৭৯ সালে শেষ হয়। ১৯৯১ সালে দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ঐ সময় চীনকে সন্তুষ্ট করতে ভিয়েতনাম নিজের স্বার্থেও অনুকূলে যায় না এমন কিছু শর্তও মেনে নিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল নিজ ভূখণ্ডে ভিয়েতনাম তৃতীয় কোনো দেশের সামরিক ঘাঁটি গাড়তে দেবে না। এখন হ্যানয়-ওয়াশিংটন কৌশলগত অংশীদারিত্ব বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করতে পারে।
বেইজিং মনে করতে পারে, ইতিপূর্বে তাদের সঙ্গে করা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করতে ইতস্তত করতে পারে ভিয়েতনাম। তাছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে জলসীমা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধ ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করে হ্যানয়।
সম্প্রতি ভিয়েতনামে যে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলেছে তাতে ক্ষমতাসীন দলের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েক জন শীর্ষ নেতা পদচ্যুত হয়েছেন। পদ হারানো নেতৃবৃন্দ মার্কিনপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরিবর্তে যারা দলের সেই পদগুলোতে এসেছেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। মনে হচ্ছে, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে দুই বৃহত্ শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে অগ্রসর হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক ভিয়েতনামকে বিশেষ কোনো সুবিধা দিবে না। বর্তমানে দুদেশের সম্পর্ক মূলত সেই পর্যায়ই আছে। এই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক মর্যাদা পাবে মাত্র। তবে এর মাধ্যমে ভিয়েতনামের মাটি সামরিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় যে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ পাবে। উল্লেখ্য, চীনের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির দ্বিতীয় অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক অংশীদার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.