নিজস্ব প্রতিবেদক: অবহেলা অযত্ন ও গাফিলতিতে সু-চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না দেশের প্রায় সোয়া চার কোটি মানসিক রোগী। তবে এই সব মানসিক রোগীদের সুচিকিৎসা ও গবেষণার জন্য যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এ জন্য গত সোমবার জাতীয় অর্থনেতিক নির্বাহী কমিটি (একনেক) এর সভায় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রকল্প অনুমোদনের খবরে পাবনার মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
সুত্র জানায়, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পাবনা মানসিক হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হিসেবে রূপান্তর হবে। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাবনা মানসিক হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫শ’ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার শয্যা হবে। সাথে থাকবে গবেষণা, কেস স্টাডি ও মানসিক রোগীদের পুর্নবাসনও।
সুত্র জানায়, মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের উদ্যোগে প্রায় দুই বছর আগে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। অজ্ঞাত কারণে একনেকে অনুমোদনের আগেই তা স্তিমিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিএনপির চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং একনেকে প্রকল্পটি উত্তোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
পাবনা মানসিক হাসপাতাল সুত্র জানায়, জনসংখ্যার প্রতি চারজনে একজন মানসিক রোগী রয়েছে। সে তথ্য অনুযায়ী ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে প্রায় সোয়া চার কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিপুল এই জনগোষ্টির চিকিৎসায় একমাত্র পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ছিল মুল ভরসা। ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল “মানসিক স্বাস্থ্য একটি সার্বজনীন মানবাধিকার”। এই প্রতিপাদ্য ছিল স্তরে স্তরে উপেক্ষিত।
পাবনা মানসিক হাসপাতাল সুত্র আরও জানায়, এই সোয়া চার কোটি মানুষের মধ্যে নারী পুরুষ মিলে প্রাপ্ত বয়স্করা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং শিশু কিশোররা ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ রোগী। পাবনা মানসিক হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫‘শ । এর মধ্যে ৩৫০টি জেনারেল বেড এবং ১৫০টি পেয়িং বেড। সব বেডেই রোগীতে ভর্তি থাকে সারাবছর। দেশের বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যর চিকিৎসাও অপ্রতুল। ঢাকার মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে ১‘শ মানুষ চিকিৎসা নিতে পারে। ফলে সব মিলিয়ে দেশের সোয়া ৪ কোটি মানসিক রোগীর মধ্যে সেবা দেওয়া হচ্ছে মাত্র দশমিক শুন্য শুন্য ১৬৭ শতাংশ রোগীকে। চিকিৎসা সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে অধিকাংশ রোগী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, একজন মানসিক রোগীর জন্য দিনে ১০ প্রকারের ঔষধ প্রয়োজন হয়। অর্থভাবে সেখানে মাত্র ৩ প্রকারের ঔষুধ দেওয়া হচ্ছে। খাবার নিয়ে রয়েছে নানা সমস্যা। নিম্নমানের খাবারের ফলে রোগীরা প্রোটিনের অভাবে দিনদিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া অন্তত সাতজন রোগী সুস্থ হওয়ার পরেও দীর্ঘ ৪০ থেকে ৫০ বছর হাসপাতালে রয়েছেন।
সুত্র জানায়, সারাদেশের মানসিক রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই হাউজে অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এর দুই বছর পর ১৯৫৯ সালে পাবনা শহরের অদূরে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালটি। প্রাথমিক অবস্থায় হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ছিলো ৬০টি। সময়ের চাহিদায় যা বৃদ্ধি করা হয় ৫০০ শয্যায়। শয্যা সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসকের পদ। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। স্বল্পসংখ্যক কর্মচারী দিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের বহিঃবিভাগে রোগী দেখার সময় সীমা ও হাসপাতাল চত্বরের যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের অভিযোগ।
সুত্র জানায়, বর্তমানে এই হাসপাতাটিতে ৩১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ২২ জন, ১১৯ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর বিপরীতে ৭২ জন আর ১৭০ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর বিপরীতে কর্মরত আছে মাত্র ৬১ জন।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ সেলিম মোরশেদ নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে জানান, একজন মানসিক রোগীর জন্য মেডিসিন, সেবা ও শারীরিক প্রোটিন অপরিহার্য। কিন্তু তা মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। একনেকে এই প্রকল্প পাশের মাধ্যমে দেশের সোয়া চার কোটি মানুষকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ এহিয়া কামাল বলেন, হাসপাতালটির শয্যা সংখ্যা ১২‘শ তে উন্নিত করার কথা থাকলেও ১০০০ শয্যা করা হয়েছে। এটাই সু খবর। এটি বাস্তবায়িত হলে দেশের আরো বেশি মানসিক রোগী চিকিৎসা পাবে। তবে শয্যা সংখ্যার পাশাপাশি যেন জনবলও সে হারে বাড়ানো হয় সে দাবি জানান তিনি।
বিএনপির চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিষয়টি নিশ্চিত করে তার বলেন, পাবনাবাসী ও দেশের সোয়া চার কোটি মানসিক রোগীর জন্য সুখবর। তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুকে লেখেন “আলহামদুলিল্লাহ, দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত “মানসিক হাসপাতাল, পাবনাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রূপন্তর প্রকল্প” আজ একনেকে (এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দ্য ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিল) অনুমোদন পেয়েছে। ৩ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটির মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১,৩৬৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাবনা মানসিক হাসপাতাল ৫০০ শয্যা থেকে এক হাজার শয্যায় উন্নীত হবে। দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রায় দুই বছর আগে এ প্রকল্পের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে বিএনপির চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস একনেকে প্রকল্পটি উত্তোলনে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাবনা তথা সমগ্র দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে ইনশাআল্লাহ”।
পাবনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্প অনুমোদনের মধ্যে দিয়ে এই সরকার পাবনাবাসীর কাছে চির স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও শিমুল বিশ্বাসের চেষ্টার কথাও স্মরণ করেন। পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, পাবনাবাসীর জন্য এটা একটি যুগান্তকারী খবর।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম / পাবনা। #