মমতা’র আশ্রয়ে ফিরেও শুভেন্দুর চাপে মুকুল

(মমতা’র আশ্রয়ে ফিরেও শুভেন্দুর চাপে মুকুল–ছবি: প্রতিনিধির)
কলকাতা-হাওড়া (ভারত) প্রতিনিধি: পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগে মেদিনীপুর শহরের কলেজমাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর জনসভায় শুভেন্দু অধিকারী যখন তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন,মঞ্চে দাঁড়িয়েই তখন ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন মুকুল রায়। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন শুভেন্দু নিজেও।
বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি মুকুল রায় নাকি শুভেন্দু অধিকারীকে প্রায়ই বলতেন, “ তৃণমূলে সম্মান নিয়ে থাকতে পারবি না তুই। বিজেপিতে চলে আয় শুভেন্দু।” সত্যিকথা বলতে কী, শুভেন্দুকে বিজেপিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাঁর সাফল্যের দাবি বেশ গর্বের সঙ্গেই মুকুলবাবু তুলে ধরতেন ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের সঙ্গে আড্ডা বা বৈঠকে।
সেই মুকুল রায়কেই পিএসি চেয়ারম্যান করার প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বিধানসভার ৮টি কমিটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন ৮ বিজেপি বিধায়ক- মনোজ টিগগা, মিহির গোস্বামী,  নিখিলরঞ্জন দে, বিষ্ণুপদ শর্মা, কৃষ্ণ কল্যাণী, দীপক বর্মন, আনন্দময় বর্মন এবং অশোক কীর্তনীয়া।
শুধু তাই নয়, কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে বিজেপির  প্রতীকে জয়লাভ করে মাসখানেক পরেই তৃণমূলে যোগদান করা মুকুলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার দাবিতে আজ মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) শুভেন্দুর নেতৃত্বে বিজেপি বিধায়কদের এক প্রতিনিধি দল রাজভবনে গিয়ে দেখা করলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে।
নেপথ্য কাহিনি বা নিজের মনে সুপ্ত ইচ্ছে যা-ই হোক না কেন, তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন আগেও বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হিসেবে শুভেন্দু অধিকারীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন মুকুলবাবুই। কিন্তু আচমকাই সেই মুকুল রায়ের তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার ঘটনা এতটাই মানসিকভাবে আঘাত করেছে শুভেন্দু অধিকারীকে যে তাঁর বিধায়ক পদ খারিজের জন্য আইনের হাত ধরেই উঠে পড়ে লেগেছেন বিরোধী দলনেতা।
দিন কয়েক আগে বিধানসভা অধিবেশনের শেষ মুহূর্তে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি)র চেয়ারম্যান হিসেবে মুকুল রায়ের নাম অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন একমাত্র বিরোধী দল বিজেপির বিধায়করা। দলত্যাগ বিরোধী আইনে যাঁর বিধায়ক পদই থাকার কথা নয়, তাঁকে পিএসির চেয়ারম্যান করা হলো কোন যুক্তিতে- এই প্রশ্ন তুলে ওয়াক আউট করেন বিজেপি বিধায়করা।
তাঁদের বক্তব্য, সরকার পক্ষের খরচে স্বচ্ছতা রক্ষার জন্য পিএসি চেয়ারম্যানের পদটি বিরোধীপক্ষকে দেওয়াই রীতি। কিন্তু সেই রীতি ভেঙে এই পদে এমন একজনকে বসানো হলো, নির্বাচনে জেতার পরেই দলবদলের ফলে যাঁর বিধায়ক পদটিই আজ বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে।
প্রসঙ্গত, এ ব্যাপারে শুনানির দিন ধার্য হয়েছে আগামী ১৬ জুলাই।
তথ্যপ্রমাণ সহ কাগজপত্রও দাখিল করেছেন শুভেন্দু আধিকারী। দলবদলের পরেই মুকুল রায় অবশ্য মন্তব্য করেছিলেন, যা হওয়ার আইন মেনেই হবে। তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়ের যুক্তি, অধ্যক্ষ তাঁর পদাধিকারবলে আইন অনু্যায়ী সঠিক পদক্ষেপই করছেন। কাউকে বিধায়ক পদে রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার আছে একমাত্র তাঁরই। এটা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রসঙ্গত, অতিসম্প্রতি স্ত্রী  বিয়োগে  মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মুকুলবাবু অবশ্য বেশিরভাগ সময়ই নিজেকে কার্যত বন্দি রেখেছেন তাঁর কাঁচড়াপাড়ার বাড়িতেই।
অত্যন্ত মিষ্টভাষী,ভদ্র,বুদ্ধিমান এবং হাসিমাখা মুখের পরিণত রাজনীতিবিদ হিসেবে মুকুল রায়ের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দক্ষ সংগঠক। কম কথা বলেন। পছন্দ  করেন নিজেকে আড়ালে রাখতে। দুমদাম করে কারও বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য করে বসা তাঁর ধাতে সয় না। ঠান্ডা মাথা। ব্যবহারেও অত্যন্ত আন্তরিক। তবুও বিতর্ক কিছুতেই যেন তাঁর পিছু ছাড়ে না। পুরনো বিতর্ক, নতুন বিতর্ক। মাঝেমধ্যেই তাঁর ঠান্ডা আচরণে বিস্ময়ের যেন সীমা থাকে না। কেমন যেন অচেনা মানুষ মনে হয় তাঁকে। খুব কাছেরও কিছু মানুষের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সেই কথাই বলছে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে প্রত্যাশিতভাবেই অনায়াসেই বেশ বড় ব্যবধানে হারিয়ে দেন তৃণমূল প্রার্থীকে। কিন্তু মুকুলের নিজের এলাকা বীজপুরে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যান তাঁর পুত্র ১০ বছরের  বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়। মুখ থেকে হাসি উবে যায় মুকুল রায়ের। এরপরেই কেমন যেন নিজেকে দ্রুত বদলে ফেলেন মুকুল রায়।
তৃণমূলের একসময়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রাক্তন রেলমন্ত্রী এবং জাহাজ প্রতিমন্ত্রী বিজেপিতে যোগ দিয়েই নিজের কর্মকুশলতার দৌলতে বাংলায় বিজেপিকে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে দলকে বাংলার ১৮টি আসনে জেতানোর নেপথ্য কারিগর হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কাছের  লোক হয়ে উঠেছিলেন রাতারাতি। রাজ্যে দলের মধ্যে বিরোধীপক্ষের  আচরণ তাঁকে কিছুটা অস্বস্তিতে রাখলেও, তারজন্য বিজেপি ত্যাগ করা ঠিক কতটা  জরুরি ছিল মুকুল রায়ের, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সত্যিই গভীর গবেষণার বিষয়। বিজেপি-ত্যাগের কারণ তিনি লিখিতভাবে জানাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের। কিন্তু সত্যিই জানিয়েছেন কীনা তা আজও অজানা।
এটা ঘটনা, দল ভাঙানোর খেলায় অত্যন্ত পারদর্শী মুকুলের হাত ধরে অনেকেই যেমন বিজেপি থেকে তৃণমূলে ফিরতে আগ্রহী, তেমনি এটাও সত্যি, তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ অনুগামীই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূলে ফেরার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তাঁদের ধারণা, বিজেপি-তে থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলেই ক্ষমতার মোহে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর এই ‘ঘরে ফেরা’। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরলে অন্তত কোনও রাজ্যের রাজ্যপালের সম্মান হয়তো পেতে পারতেন মুকুল রায়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বাধিনায়িকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈশিষ্ট্য, তাঁর প্রসারিত মনের উদারনৈতিক রাজনীতির ঘরানা। তাই শুধুমাত্র নিজের কাজ, জনপ্রিয়তা এবং সংগঠনের জোরেই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসা সত্ত্বেও দলে হাসিমুখেই স্বাগত জানিয়েছেন পুরনো সেনাপতি মুকুলকে। কিন্তু তাঁর সেই পদ- সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের স্বীকৃতি ফিরিয়ে দেওয়া কি আর সম্ভব? সেখানে তো বসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহের ভাইপো  সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়তো বিকল্প কোনও ‘ভালো জায়গা’ই ভাবা হচ্ছে মুকুল রায় এবং তাঁর ছেলে শুভ্রাংশুর জন্য। কিন্তু এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবেই ‘চানক্য’ মুকুল রায়কে মারাত্মক চাপের মুখে ফেলে দিয়েছেন লড়াকু বিরোধী দলনেতা ঐতিহাসিক জমিরক্ষা আন্দোলনের নায়ক নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ(বাংলাদেশ) এর কলকাতা-হাওড়া(ভারত) প্রতিনিধি সৌম্য সিংহ। # 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.