‘ভৌতিক নৌবহর’: পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে তেল বিক্রি করছে রাশিয়া

 

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের দুই বছর শেষ হতে চলল। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি আসলেই দুই বছর হয়ে যাবে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পরপরই পশ্চিমা বিশ্ব মস্কোর তেল রপ্তানির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু রাশিয়া সেই নিষেধাজ্ঞা বাইপাস করে ঠিকই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্বালানি তেল বিক্রি করেই যাচ্ছে এবং এ কাজে রাশিয়াকে নির্ভরতা দিচ্ছে ‘ভৌতিক নৌবহর’।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ভৌতিক নৌবহরের অস্তিত্ব ছিল। রাশিয়া মূলত অস্বচ্ছ মালিকানা ও পর্যাপ্ত বিমার ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে এর মাধ্যমে তেল রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, রাশিয়া নিজেরই একটি ঘোস্ট ফ্লিট বা ভৌতিক নৌবহর গড়ে তুলেছে। যাতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিশ্ব বাজারে তেল রপ্তানি বজায় রাখতে পারে।
ভৌতিক নৌবহর আসলে কী
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকস ভৌতিক নৌবহরকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছে, এমন সব নৌযান যেগুলো জি-৭ ভুক্ত দেশ বা তাদের মিত্র কোনো দেশ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশের মালিকানাভুক্ত নয়। এসব নৌযানের সুরক্ষা ও দায়মুক্তি বিমাও নেই।
এ বিষয়ে কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ এলিনা রোবাকোভা বলেন, ‘এই বিষয়টি (ভৌতিক নৌবহর) একেবারেই নতুন কোনো বিষয় নয়। এমনকি যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ) শুরুর আগেও এই ধারণা বজায় ছিল আমাদের বিশ্বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনে ছায়া নৌবহর সাধারণ প্রচলিত ব্যবসায় মডেলকে এড়িয়ে চলে। যাতে বিমার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে না হয়।’
থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক এলিজাবেথ ব্রাউ বলেছেন, এ ধরনে নৌবহরকে ‘অন্ধকার বহরও’ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ইরান ও ভেনেজুয়েলা এ ধরনের নৌবহর ব্যবহার করে তাদের তেল বাণিজ্য চালাতে। উত্তর কোরিয়াও এ ধরনের নৌবহর ব্যবহার করে।
ব্যবসায় গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান লয়েডস লিস্ট ইন্টেলিজেন্সের পরিসংখ্যান অনুসারে, এই ধরনের জাহাজের সংখ্যা গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ দ্বিগুণ হয়েছে ও আন্তর্জাতিকভাবে তেলবাহী ট্যাংকারের প্রায় ১০ শতাংশই ভৌতিক বহর। আটলান্টিক কাউন্সিল গত জানুয়ারিতেই জানিয়েছে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জাহাজ আছে যেগুলোর মালিকানা স্পষ্ট নয় অর্থাৎ এগুলো ভৌতিক নৌবহরের অংশ।
রাশিয়া কেন ভৌতিক নৌবহর ব্যবহার করছে
ইউক্রেনে আক্রমণের অভিযোগে রাশিয়ার ওপর তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ও তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। এমনকি যেসব জাহাজ কোম্পানি রাশিয়ার তেল পরিবহন করত সেগুলোরও ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল তারা।
মূলত পশ্চিমা বিশ্বের জাহাজের ওপর নির্ভরতা কমাতেই রাশিয়া নিজে ট্যাংকার কিনে সেগুলোকে নিজে নিজেই বিমা করিয়ে সাগরে নামিয়েছে। এ বিষয়ে রোবাকোভা বলেন, রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির ৭০ শতাংশেরও বেশি হয় ভৌতিক নৌবহর ব্যবহার করে। কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকসের অনুমান, রাশিয়ার বিভিন্ন বন্দরগুলো ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১৭৯টি ‘ভৌতিক নৌবহরের’ জাহাজ ভিড়েছে।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকস গত অক্টোবরে এক প্রতিবেদনে বলেছে, রাশিয়ার ভৌতিক নৌবহর রাশিয়ার দৈনিক উৎপাদিত ১ কোটি ব্যারেল তেলের মধ্যে ২৩ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত ও ৮ লাখ ব্যারেল অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য রপ্তানি করেছিল।

ভৌতিক নৌবহরের ঝুঁকি কোথায়

লয়েড লিস্ট ইন্টেলিজেন্স গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘এই ভৌতিক বহরে থাকা বেশির ভাগই নৌযানই সম্প্রতি কোনো ধরনের ইন্সপেকশন করা হয়নি। নিম্নমানের রক্ষণাবেক্ষণ, অস্পষ্ট মালিকানা, কোনো বিমা না থাকার পরও নিষেধাজ্ঞা ও উচ্চ বিমা খরচ এড়াতে এগুলো পরিচালিত হয়েই যাচ্ছে।
কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকস জানিয়েছে, আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়া বা প্রায় শেষ হয়ে গেছে এমন অনেক ট্যাংকারই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই জাহাজগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো জন্য বিশাল পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ এই ট্যাংকারগুলোর বড় একটি অংশই ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ ঘেঁষেই চলাচল করে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের মধ্যে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় আগে নির্মিত ট্যাংকারগুলো বিশ্বের মোট ট্যাংকারের সংখ্যার ১১ শতাংশ হয়ে যাবে। অথচ, ইউক্রেনে যুদ্ধের আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।
রাশিয়ার ভৌতিক নৌবহরের কোনো জাহাজেরই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ও দায়মুক্তি বিমা নেই। ফলে কোনো কারণে—যেমন যুদ্ধ, সংঘর্ষ বা দুর্ঘটনায় যদি এসব ভৌতিক নৌবহরের কোনো জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সে কারণে সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়ে তবে তা থেকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি করেছে। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.