ভোলাহাটে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম, প্রকৃত অসহায়রা বঞ্চিত, পেয়েছে জঙ্গির পরিবারও বাড়ি


চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: ভোলাহাটে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত অসহায় ও ভূমিহীন পরিবারগুলো বঞ্চিত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর এই বাড়ি উপহার হিসেবে পেয়েছেন হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় অন্যতম মাস্টার মাইন্ড ও অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষক জঙ্গি সারোয়ারের বড় ভাই মনিরুল।
জেনে শুনেও এই জঙ্গীর পরিবার ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপহার’ পাওয়ায় ক্ষুদ্ধ স্থানীয় আওয়ামীলীগ, জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল। বাড়ি নিয়ে বসবাস না করে, সেখানে গবাদী পশু পালন ও সুযোগ পেয়ে মাদকসেবীদের আস্তানা গড়ে উঠেছে সেখানে।
নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে এলাকায় এমন ঘটনায়। তবে, উপজেলা প্রশাসনের দাবী, ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সুপারিশেই পরিবারটিকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সুত্র ও সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, “তোমরা হতাশ হবে না। একজনের গুলি শেষ হলে অপরজন ব্যাকআপ দেবে। মনে রাখবে, আমাদের হারানোর কিছু নেই। অপারেশনের সময় তাড়াহুড়ার দরকার নেই। খুব গুারুত্ব দিয়ে কাজ করবে। আর মুশরেকদের দয়া দেখাবে না। এমনকি সে যদি সাংবাদিকও হয়। যদি কেউ বন্দি হয়ে যাও, তাহলে নিজেই নিজেকে শেষ করে দিবে। আর একটা জিনিস, হলি আর্টিজানের গেইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই আমরা সফল। কারণ, বিশ্ব জেনে যাবে যে বাংলাদেশেও হামলা হয়েছে। তাই শুধু হামলা হলেই আমরা সফল। আমরা বিজয়ী।”
হলি আর্টিজানে হামলার আগেরদিন বসুন্ধরার একটি বাসায় হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনার সময় মূল হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে এমনই উদ্বুদ্ধকরণ খুতবা/বয়ান দিয়েছিলেন হামলার অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় অন্যতম মাস্টার মাইন্ড ও অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন সারোয়ারের নাম।
এই সারোয়ার জাহান ওরফে মানিকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার দলদলী ইউনিয়নের মুশরীভুজা গ্রামে। বৈশ্বিক জঙ্গি সংগঠন আইএসআই’র আদলে গড়ে উঠা নব্য জেএমবি সংগঠনের শীর্ষ নেতা সারোয়ার জাহানের পরিবার পেয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপহার! ভূমিহীন কিংবা ২ শতকের নিচে জমি থাকা পরিবার জমিসহ ১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়ি পাওয়ার কথা থাকলেও জঙ্গি সারোয়ারের বড় ভাই মনিরুলের পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে ১৪ শতকের বেশি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে একজন জঙ্গি পরিবারের সদস্য পেয়েছে এই বাড়ি! জঙ্গি সারোয়ারের পরিবার ও ইউপি চেয়ারম্যানের দাবি, ভূমিহীন দরিদ্র হওয়ার সুবাদেই বাড়ি পেয়েছে তারা। বাস্তবে, সারোয়ারের বাবা আব্দুল মান্নানের নামে দুটি খতিয়ানে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ জমি রয়েছে। পৈত্রিক সূত্রে ১৪ শতকেরও বেশি জমি রয়েছে সারোয়ারের ভাই মুদি দোকানী মনিরুল ইসলামের নামে।
এছাড়া, শুধু জঙ্গি পরিবার নয়, ভোলাহাট উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি দেয়া নিয়ে রয়েছে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ। দলদলী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বলেন, এই গ্রামে অনেক হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে। যারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপহার পাওয়ার যোগ্য।
অথচ তা না করে, জমি রয়েছে এমন জঙ্গি পরিবারের সদস্যকে বাড়ি দেয়া হয়েছে। চূড়ান্তভাবে বাড়ি প্রদানের আগেই ভোলাহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারনে পরিবারটিকে বাড়ি দেয়া হয়েছে।
এই যুবলীগ নেতা আরো বলেন, দলদলী ইউনিয়নে এখনো অনেক ভূমিহীন, অসহায়, দরিদ্র পরিবার বসবাস করছে। অথচ এমন কয়েকটি বাড়ি দেয়া হয়েছে, দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কেউ সেখানে বসবাস করছে না। গরু-ছাগলের বসবাস ও গাঁজাখোরদের আস্তানা হিসেবে এসব বাড়িতে বসছে মাদকের আড্ডা। সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, ভোলাহাটে সবগুলো বাড়ি যোগ্য পরিবারগুলো পায়নি। আগের বাড়িতে বসবাস করে, অথচ এমন পরিবারগুলোও বাড়ি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেয়া বাড়িগুলোতে বসবাস করছে গরু-ছাগল। একজন শিক্ষক বলেন, বাস্তবে সঠিকভাবে গরিব, অসহায়, দুঃস্থ, ভূমিহীন পরিবারগুলো আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি পেলে প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ সার্থক হয়।
কিন্তু ভোলাহাটে সেটা হয়নি। অসহায়, ভূমিহীন পরিবারগুলো বাড়ি না পেয়ে, বাড়ি ও জমি রয়েছে এমন পরিবার বাড়ি পেয়েছে। একেবারেই পায়নি অসহায়, ভূমিহীন পরিবারগুলো, সেটা নয়। যারা প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার পাওয়ার যোগ্য, তাদেরকেই দেয়ার দাবি জানান তিনি।
দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য হাবিবুল্লাহ মেসবাহ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, কে বা কারা হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারী সারোয়ার জাহানের ভাই মনিরুলকে বাড়ি প্রদানের বিষয়ে আগেই অভিযোগ করে। প্রেক্ষিতে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ইউপি চেয়ারম্যান তদন্ত করার পর মনিরুলকে বাড়িটি দেয়া হয়েছে।
এবিষয়ে (জঙ্গি সারোয়ার) ভাবি সালমা খাতুন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, জঙ্গি সারোয়ার জাহান ওরফে মানিকের সাথে পরিবারের কোন সম্পর্ক ছিলো না। আমার শশুরের জমি-জমা ছিলো, কিন্তু তিনি তা বিক্রি করে শেষ করছেন। কোন রকমে মুদি দোকানের মাধ্যমে সংসার চালায়, তাই বাড়িটি আমাদের দেয়া হয়েছে।
দলদলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আরজেদ আলী ভুটু বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, কোন অনিয়ম নয়, সঠিকভাবে এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার। জঙ্গি সারোয়ারের পরিবার জমি থাকা স্বত্বেও বাড়ির পাওয়ার বিষয়ে ভোলাহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাব্বুল হোসেন সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
ক্যামেরার সামনে বক্তব্য দেয় না, জানিয়ে মুঠোফোনে ভোলাহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মশিউর রহমান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, মনিরুলের জমি আছে, এটা আমাদের জানা নেয়। জঙ্গি সারোয়ার জাহানের পরিবারের লোক ও জমি থাকা নিয়ে একটি অভিযোগ হলেও শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সুপারিশে পরিবারটিকে বাড়ি দেয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে কোন অনিয়ম হয়নি।
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনাকারী সারোয়ার জাহান ওরফে মানিকের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেয়া বিষয়ে ভোলাহাট উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ইয়াসিন আলী শাহ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, প্রশাসন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাথে সমন্বয় বা পরামর্শ না করেই জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। মনিরুলের বাড়ি পাওয়াসহ আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়মের নানা অভিযোগ উঠছে, বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দু’জনই আ.লীগের নেতা। অথচ নিজ এলাকায় এমন অনাকাঙ্খিত বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি।
জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, জঙ্গি পরিবারকে এই বাড়িটি দেয়ার মাধ্যমে অন্য তরুণদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এঘটনার মধ্য দিয়ে নবাগত জঙ্গিরা নিজেদের পরিবারকে আরো বেশি সুরক্ষিত মনে করবে। এতে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রমে আরো বেশি গতি আসবে এবং আত্মঘাতী হামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। বিষয়গুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করে খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ।
উল্লেখ্য, কখনো মোক্তার, কোথাও নাজমুল, আবার কখনো আবদুর রহমান আয়নাল, কোথাও আসিম আজওয়াদ নামে পরিচয়দানকারীর প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান বলে দাবী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)’র। র‌্যাবের দাবী, বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবতকালের সবচেয়ে ভয়ংকর এবং দুঃসাহসিক সব সন্ত্রাসী হামলার নেপথ্যের মূল ব্যক্তি এই সারোয়ার। সাবেক র‌্যাব মহাপরিচালক (বর্তমান বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিচালক) বেনজির আহমেদ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দাবী করেন, সারোয়ার জাহানই ছিলেন বাংলাদেশে নব্য জেএমবির প্রধান নেতা। গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা, শোলাকিয়া ঈদের জামায়াতে সন্ত্রাসী হামলাসহ বাংলাদেশের ২২টি সন্ত্রাসী হামলা তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো: আশরাফুল ইসলাম রঞ্জু। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.