ভারতে মেয়েদের খেলার রাজ্য যৌন-হেনস্থায় ভরা

ফাইল ছবি
বিটিসি স্পোর্টস ডেস্ক: শুধু ফুটবল নয়, কুস্তি, বক্সিং, অ্যাথলেটিক্স, সর্বত্রই এটা সত্য। মেয়েদের সমানে যৌন হেনস্থার মুখে পড়তে হয়। কিছুদিন আগে পুলিশের তরফ থেকে কলকাতায় মেয়েদের একটা ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল।
সেখানে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়ে ফুটবলাররা খেলতে এসেছিলেন। সে সময় দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদসহ অনেক জেলার মেয়ে ফুটবলাররা বলেছিলেন, ফুটবল খেলতে গিয়ে তাদেরও নানা বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে শর্টস ও টি শার্ট পরে খেলার জন্য। বাড়ির থেকে বাধা এসেছে।
প্রতিবেশী, গ্রামবাসীদের টিটকিরি শুনতে হয়েছে। দূরে গিয়ে প্রাকটিস করার ক্ষেত্রে বাধা এসেছে। তাও তারা খেলা ছাড়েননি। কারণ, অসম্ভব গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা এই মেয়ে ফুটবলারদের কাছে মাঠ হলো মুক্তির জায়গা। খনিকটা খোলা হাওয়া গায়ে মেখে মুক্তির স্বাদ নেয়া। যেখানে নিয়মের, নিষেধের বেড়াজাল থাকবে না।
যেখানে বলকে গোলের নিশানার মধ্যে ঢুকিয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠা যাবে। হাড়ে মজ্জায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মধ্যে থাকা মানুষগুলি তো এটা মানতে পারবে না। মেয়েরা খেলছে, সেটাও শর্টস পরে, পুরুষদের নিষেধ না মেনে, এত বড় অন্যায়তো আর হতে পারে না। ফলে সীমান্তের দুই পারে মনোভাবটা খুব আলাদা নয়।
ফারাক একটাই। এই অপরাধের জন্য মেয়েদের ওপর প্রকাশ্য হামলা করে মারধর করা হয়নি, এটাই যা ফারাক। তবে প্রতি পদেই তো হেনস্থার শিকার হতে হয় মেয়েদের। কুস্তিগিরদের কথাই ধরুন। তারা ফেডারেশনের কর্তার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করলেন। একজন নয়। একাধিক নারী কুস্তিগির।
সাতজন তো পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তার বাইরেও অনেকে আছেন, যারা লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। দিল্লির যন্তর মন্তরে তারা দু দফায় বিক্ষোভ দেখালেন।
কারা এই বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন? অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস ও কমনওয়েলথ গেমসে পদকপ্রাপ্ত কুস্তিগিররা। বজরঙ্গ পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, বীনেশ ফোগত। কিন্তু অনেক লড়াই করেও বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ সিংকে ফেডারেশন কর্তার পদ থেকে সরাতে পারলেন না। তার বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে।
কিন্তু তারপর? সাক্ষীরা বোধহয় বুঝতে পেরেছেন, এর থেকে অলিম্পিক বা এশিয়ান গেমসের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ। ভারতে মেয়ে ক্রীড়াবিদরা তো বারবার যৌন হেনস্তার অভিযোগ করে এসেছেন। বছর দুই আগে সাতজন নারী অ্যাথলেট কোচ নাগরাজনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন।
তার মধ্যে একজনের বয়স মাত্র ১৩ বছর। নাগরাজন তাকেও ছাড়েনি। প্রতিবাদ করতে গেলেই হত্যা করার ভয় দেখাতেন। পরে অভিযোগ সামনে আসার পর এখন সে জেলে। কড়া পসকো আইন প্রয়োগ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গতবছরই চিফ সাইক্লিং কোচ আর কে শর্মাকে বরখাস্ত করে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা সাই। কারণ, অভিযোগ ছিল, স্লোভানিয়ায় গিয়ে সে একজন নারী সাইক্লিস্টকে হোটেলে এক ঘরে থাকতে বাধ্য করেছিল।
এমনকি ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্সার মেরি কমও যৌন নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পাননি। তিনি জানিয়েছিলেন, প্রথমে মণিপুরে, তারপর দিল্লি ও হিসারে তাকে যৌন নিগ্রহের মুখে পড়তে হয়েছিল। ভারতের নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক সোনা চৌধুরী একটা বই লিখেছেন। গেম ইন দ্য গেম।
সেখানে তিনি বলেছেন, ফেডারেশনের কর্তারা কীভাবে যৌন ও মানসিক অত্যাচার চালাতেন। এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে কিছু নারী ফুটবলার নিজেদের মধ্যে লেসবিয়ানের মতো ব্যবহার পর্যন্ত করতেন।
খারাপ ব্যবহার করার জন্য ভারতের মেয়েদের ১৭ বছরের কম বয়সীদের ফুটবল প্রতিযোগিতা চলার সময় নরওয়ে থেকে সহকারী কোচকে সাসপেন্ড করে ডেকে পাঠানো হয়। আর কত উদাহরণ দেব।
আসলে এই উপমহাদেশের পুরুষরা তো মেয়েদের শরীরের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না। তাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতা, মেয়েদের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা, প্রভুত্বের মনোভাব থেকেই তো তারা বারবার মেয়েদের উপর অত্যাচার করে।
তারা নানান ফতোয়া দেয়, কখনো পোশাক নিয়ে, কখনো আচরণ নিয়ে, কখনো তারা বলে পড়াশুনো করা যাবে না, কখনো বলে চাকরি করা যাবে না, কখনো বলে খেলাধুলা করা যাবে না। ফতোয়া না মানলে মার তো আছেই। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে মারা হয়েছে বলে এত হইচই হচ্ছে। আর যে মার প্রকাশ্যে আসে না, তার বেলা? আশার কথা একটাই। এরপরও মেয়েরা লড়াই ছাড়ছে না। চাক দে ইন্ডিয়া সিনেমাটা মনে আছে।
সেটা তৈরি হয়েছিল, ভারতীয় হকি দলের মেয়েদের নিয়ে। সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার অনেকটাই সত্যি হয়েছিল। ভারতে মেয়েদের অনেক লড়াই করে, নির্যাতন সহ্য করে, যৌন লাঞ্ছনার মুখে পড়ে লড়াই চালাতে হয়।
তারপর তারা মেরি কম হতে পারেন। হয়ে উঠতে পারেন সফল ফুটবলার, ক্রিকেটার বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিত্ব। তার জন্য তাদের এই লড়াইটা অনেক কঠিন, দামী, আর সেজন্যই তাদের সেলাম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.