ব্ল্যাক বোর্ড বনাম হোয়াইট বোর্ড

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: আমরা যারা ছোট বেলায় স্কুলে গেছি বা পড়ালেখার সাথে যুক্ত ছিলাম এবং ৫০ পার করেছি, তাদের প্রত্যেকের হাতে খড়ি স্লেট-পেনসিল দিয়ে। একটা কালো স্লেটের উপর লেখার পর তা আবার কয়লা দিয়ে পরিস্কার করে রোদে শুকিয়ে লেখার উপযোগী করা ছিল আমাদের দৈনন্দিন কাজ।
এ কাজ করতে আমরা তখন খুব আনন্দ পেতাম! স্কুলে স্যারেরা ব্ল্যাক বোর্ডে লেখার পর ভাঙ্গা চক কুড়িয়ে ক্লাসের বিরতিতে ব্ল্যাক বোর্ডে হিজিবিজি লিখেও আনন্দ পেতাম! সন্ধ্যায় পড়তে বসার পূর্বে হারিকেনের কাঁচে কালি পরিস্কার করেও আনন্দ পতাম। তখন সবকিছুতেই আনন্দ পেতাম! আনন্দ পেতাম না শুধু পড়ালেখাতে।
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম তখনও ব্ল্যাক বোর্ডের দেখা পেলাম। কিন্তু এখানে এসে আর চকের টুকরা কুড়ানো লাগত না। ক্লাস রুমেই চকের প্যাকেট থাকত। সেই চক ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু রতন একদিন চক দিয়ে বোর্ডে লিখল, প্রমাণ কর: ক = ২। আমরা সবাই মুখ চাওয়া-চায়ি করছি। আচ্ছা তোমরা পারবে না। সে নিজে শুরু করল, ধরি ক ২= ৪। এখন উভয় পাশের বর্গমূল করে পাই ক = ২। প্রমাণিত।
আমরা যখন জানতে চাইলাম, ক = ২ ধরব কেন? তার গম্ভীর উত্তর, এটাই নিয়ম। শিক্ষক হয়ে এখন আর চক-ডাস্টার ব্যবহার করে আনান্দ পাই না। বোর্ডে চক দিয়ে লিখলে চুলে-জামায় চকের গুঁড়া পড়ে, চুল সাদা হয়ে যায়। অবশ্য আমার চুল সাদা হওয়ার সুযোগ নাই, পুরো মাথাটায় সাদা হয়ে যায়। অনেকের নাকে-মুখে চকের গুঁড়া ঢুকে হাঁচি-কাশি হয় বলে এর ব্যবহার আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।
ব্ল্যাক বোর্ডের জায়গা দখল করে নিয়েছে হোয়াইট বোর্ড সেও অনেকদিন হলো। সঙ্গে কালো মার্কার পেন। দাম ভালোই, চকের মতো মূল্যহীন নয়। একসময় লাল-নীল-সবুজ মার্কার পেন বাজারে এলে হোয়াইট বোর্ডে রঙের পরশ লাগল। হোয়াইট বোর্ডে সাদা বাদে সব রঙই ফুটে উঠতে লাগল কিন্তু ব্ল্যাক বোর্ডে শুধু সাদা। এসব বোর্ডের পাশাপাশি পাওয়ার পয়েন্ট দিয়ে ভালোই চলছিল সময়টা। হঠ্যাৎ করে করোনা এসে আমাদেরকে গৃহবন্ধী করে ফেলল, আমূল পাল্টে গেল সবকিছু।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে আমাদেরকে অনলাইনে সামনে দাঁড়াতে হলো। দেখা পেলাম আরো কিছু বোর্ডের। ডিজিটাল র্বোড, গ্রাফিক্স বোর্ডসহ চৌদ্দ গুণিতক আট ইঞ্চির ভার্চ্যুয়াল পরিসরে জুমের মাধ্যমে আমরা ছাত্রছাত্রীদের সামনে হাজির হলাম। কাকে পড়াচ্ছি বলা মুশকিল। করোনাকালীন এ সময়ে অনলাইনে পড়াতে গিয়ে আমার একটা উপলব্ধি হয়েছে, একজন শিক্ষকের লেকচার যে মানেরই হোক না কেন ক্লাসে শিক্ষকের স্ব শরীরে উপস্থিতির বিকল্প নেই।
সাদাকালোর যুগ পেরিয়ে আমরা রঙিন যুগে পা রেখেছি তাও অনেকদিন হলো। কিন্তু সককিছু কি আমরা রঙিন করতে পেরেছি? পারিনি। আর পারিনি বলেই রঙিন যুগেও জর্জ ফ্লয়েড ও কমলা কাহিনি আমাদের সামনে সাদা বনাম কালো হিসেবে দৃশ্যমান হচ্ছে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডের পর একজন আমেরিকান বলেছিলেন, যতদিন সাদা গাড়ীর চাকা কালো থাকবে ততদিন বর্ণ বৈষম্য আমাদের জাতি বিভেদকে আরো উষকে দিবে। অবশ্য কমলা সে সুযোগ দেয়নি।
তিনি নিজেকে কালো মানুষ হিসেবেই তুলে ধরছেন। তিনি বলেছেন, ’আমি একজন কালো মানুষ, এটাই শেষ কথা। আমার জন্ম কালো মানুষ হিসেবে, মৃত্যুও হবে কালো মানুষ হিসেবে।’ কিন্তু তাঁর বিরোধীরা এটা মানতে নারাজ। বিরোধীদের বক্তব্য, কমলা সাদা মানুষ। কালোদের ভোট টানার জন্য তিনি নিজেকে কালো বলে দাবি করছে।
শুরু হয়ে গেছে গবেষণা, কমলা কতটুকু কালো আর কতটুকু সাদা। সাদাকালোর চাপাচাপিতে করোনা সেখানে চাপা পড়ে গেছে। সাদা আর কালোর যে কোনো পার্থক্য নেই এটা বোঝাতে আমাদের ছোট বেলায় পড়তে হয়েছিল, সাদা আর কালো ভেতরে সবারই সমান রাঙ্গা। কিন্তু আসলেই কি তাই! সাদা মনের মানুষ বলতে আমাদের যে ধারণা দেওয়া হয়, কালো মনের মানুষ বলতে কি আমরা সেই ধারণা পাই! যাক, এ তর্ক চলবে যুগ যুগ ধরে।
করোনা প্রতিরোধে আমাদের নানারকম করণীয় বিষয় পত্রপত্রিকায় এসেছে। প্রথমে দেখলাম ঠান্ডা প্রধান দেশগুলোতে করোনা তান্ডপ চলতে। আমরা গরম প্রধান দেশগুলোর মানুষেরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলাম। সর্তকতা হিসেবে আমরা গরম চা খাওয়া শুরু করলাম, এসির বাতাস নেওয়া বন্ধ করলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখন আবার গরম প্রধান দেশগুলোতে আক্রমণ চলছে।
করোনা প্রতিরোধে শরীরে নাকি ভিটামিন ডি নিতে হবে এবং সি খেতে হবে। এখানেও প্রকৃতি বৈষম্য তৈরী করল। কালো মানুষের নাকি ভিটামিন ডি নিতে সাদা মানুষের তুলনায় সূর্য্যের আলোতে বেশী সময় থাকতে হবে। কি আর করার! কালো জগতের আলো আর সাদা শান্তির প্রতীক-এ সান্তনাতে আমাদের জীবন চলুক।
করোনা কবে শেষ হবে জানি না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কবে প্রাণ ফিরে পাবে তাও জানি না। বোর্ড ব্ল্যাক হোক অথবা হোয়াইট হোক তাতেও কিছু যাবে আসবে না। একখন্ড চক বা একটা মার্কার পেন হাতে ছাত্রছাত্রীদের সামনে স্ব শরীরে দাঁড়াতে পারল।
লেখক-ড. আসাবুল হক, প্রফেসর, গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর রাবি প্রতিনিধি মো: মুজাহিদ হোসেন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.