ঢাকা প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কখনো মাঝারি, কখনো ভারী বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার অলিগলিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে সোমবার সকাল থেকে যানবাহনের গতি মন্থর হয়ে পড়ায় বিভিন্ন রাস্তায় যানজট দেখা দেয়।
এর সঙ্গে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়ায় রিকশা-অটোরিকশা থেকে শুরু করে বাস-মিনিবাস, টেম্পো-লেগুনাসহ সব ধরনের যানবাহনের স্বল্পতা এবং সুযোগ বুঝে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অপকৌশল। ত্রিমুখী এসব সংকটে নগরবাসীকে দিনভর ভয়াবহ নাকাল হতে হয়।
বিশেষ করে সকালের পিক-আওয়ারে অফিস-আদালত, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলমুখী মানুষকে চরম ভোগান্তির মুখে পড়ে। এ সময় গণপরিবহণের বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির জন্য বিভিন্ন স্টপেজে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সুযোগ বুঝে রিকশা-অটোরিকশা চালকরা অসহায় যাত্রীদের কাছ থেকে ‘গলাকাটা’ ভাড়া আদায় করে। বাড়তি ভাড়া দিতে অসমর্থ অনেকে বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছেছে।
অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালে সৃষ্ট বৈরী আবহাওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সোমবার সকাল মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখায় নগরবাসীর ভোগান্তি আরও একধাপ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে যেসব যাত্রী এই পরিবহণে চড়ে নিয়মিত অফিস-আদালত, কলকারখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যাতায়াত করেন, তারা পড়েছেন মহাবিপাকে।
মেট্রোরেলের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়ায় মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ কারণে প্রথমে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল, পরে চালু করে মাঝপথে থেমে থাকা যাত্রীদের নিকটবর্তী স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়।
কর্মজীবীরা জানান, গণপরিবহণ সংকটের কারণে বেশিরভাগ মানুষ নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। আবার অনেকে কাকভেজা হয়ে অফিসে পৌঁছানোর স্বল্প সময় পরই বাসায় ফেরার উদ্দেশে পা বাড়ান।
এদিকে জলবদ্ধ নগরীর বিভিন্ন অলি-গলি ও ব্যস্ত সড়ক শত শত সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটর সাইকেল ও প্রাইভেটকার বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব যানবাহনের চালকরা জানান, নগরীর অনেক সড়ক দুই-তিন ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে ভয়ংকর ফাঁদ তৈরি হয়েছে। পানির নিচে ডুবে থাকা ভাঙাচোরা রাস্তার খাদে পড়ে বিপুলসংখ্যক যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়। এ ছাড়া সড়কের জমে থাকা পানি ইঞ্জিনে ঢুকে মাঝ রাস্তায় গাড়ি বিকল হওয়ায় অনেক সড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়।
গণপরিবহণের মালিক-চালকরা জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেকে রাস্তায় গাড়ি নামাননি। তবে তাতেও গণপরিহণ সংকট হওয়ার কথা নয়। কেননা দিনভর টানা বৃষ্টি ঝরায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রায় কেউই বাসার বাইরে বের হয়নি। তাদের ভাষ্য, গণপরিবহণ সংকট সৃষ্টি হয়েছে মূলত জলবদ্ধতা ও বিপুলসংখ্যক যানবাহন বিকল হওয়ার কারণে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা প্রায় দুই কোটি মানুষের বাসস্থান ঢাকা মহানগরীতে ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা তলিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্য প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি এসব সমস্যা চিহ্নিতকরণেও সঠিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতার সংকট নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ঢাকা মহানগরীর খালগুলো ভরাট করে পরিকল্পনাহীনভাবে বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা নগর অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ফলে অনেক জায়গায় পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট-বড় নালা-নর্দমা ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। এ ছাড়া ঢাকা-শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও চরম নাজুক। কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য এখানে নেই পর্যাপ্ত ডাস্টবিন ও কনটেইনার। যা আছে তাও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ময়লা উপচে রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ড্রেনে গিয়ে পড়ে এবং ড্রেনের সুয়ারেজ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়।
অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অপেক্ষাকৃত কম ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসব ড্রেনে ময়লা জমার কারণে তরল বর্জ্যরে অবাধ চলাচলের পথ থাকে না। ফলে বর্জ্যমিশ্রিত বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ড্রেন উপচিয়ে রাস্তাঘাট সয়লাব করে দেয়। রাজধানী ঢাকার বিরাট অংশ এলাকা এখনো ওয়াসার ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের বাইরে। নগর পরিকল্পনাবিদরা আরও জানান, ঢাকার ৪টি নদী ও ৬৫টি খাল মহানগরীর পানি নিষ্কাশনে বিশেষ ভূমিকা রাখত।
কিন্তু রাজধানীর নদী, নালা-খালসহ সব প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট ও অবৈধ দখলদারের হাতে চলে যাওয়ায় এখন তা অস্তিত্বহীন। ধীরে ধীরে সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। ফলে বৃষ্টির পানি ও বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য অপসারিত হতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। যা রোববারের টানা বৃষ্টিতে নগরবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
এদিকে বর্ষা মৌসুম এলেই সেবামূলক সংস্থাগুলোর উন্নয়নমূলক কাজের প্রতিযোগিতা ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে উঠেছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। তাদের ভাষ্য, রোববার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিতে যেসব সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, ওইসব রাস্তার আশপাশে কোথাও-না কোথাও খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। কোথাও বা রাস্তার পাশের বড় বড় খাদ, মাটি ও নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ বৃষ্টির পানি চলাচলে বাধা দিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
সোমবার দুপুরে সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বংশাল, খিলগাঁও, গোড়ান, সবুজবাগ, ধোলাইখাল, নিউমার্কেটসহ কয়েকটি এলাকায় অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মানিক মিয়া এভিনিউ, ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর, গ্রিনরোড, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে মিরপুর-১৪ নম্বর যাওয়ার রাস্তাসহ সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে দুই থেকে তিন ফুট পানি জমে আছে। সেখান থেকে খুবই ধীরে পানি সরছে। এ কারণে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
নিউমার্কেট এলাকার একাধিক দোকানি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৃষ্টি হলেই নিউমার্কেট এলাকায় পানি জমে যায়। এটা কোনো নতুন চিত্র নয়। বৃষ্টির পানি জমে রাস্তায় হাঁটার অবস্থা নেই। প্রতি বছর এলাকায় জলবদ্ধতা হয়, অথচ এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ভারী বৃষ্টি হলেই নিউমার্কেট এলাকার দোকানদারদের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে ওঠে বলে জানান তারা।
পুরান ঢাকার বাসিন্দারা জানান, এমনিতেই সেখানকার বেশিরভাগ রাস্তা সরু। এর ওপর অধিকাংশ এলাকাতেই পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ফলে টানা বৃষ্টিতে বেশিরভাগ রাস্তা পানিতে ডুবে যাওয়ায় সেখানকার দোকানি ও বাসিন্দারা এক রকম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তার এপাড় থেকে ওপাড় যেতে রিকশা নিতে হচ্ছে। এর ওপর প্রবল ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের ডালপালা সরিয়ে না নেওয়ার কারণে বিভিন্ন জায়গায় যানবাহন ও পথচারী চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। পুরান ঢাকার জজ কোর্টের সামনে, ভিক্টোরিয়া পার্ক, সূত্রাপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় গাছের ডাল ভেঙে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় গণপরিবহণ সংকট এবং বিভিন্ন যানবাহনে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ ভাড়া আদায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা অনেকেই। কর্মস্থল দিলকুশায় যেতে সকাল সাড়ে আটটার দিকে রামপুরার মহানগর প্রকল্পের বাসিন্দা নূসরাত জাহান। তিনি বাসার আশপাশে রিকশা না পেয়ে হেঁটে রামপুরা কাঁচাবাজার পর্যন্ত আসেন। সেখানে মতিঝিলগামী বাসের জন্য প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করেন।
এর মধ্যে দুটি গাড়ি এলেও সেগুলো যাত্রীতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকায় তিনি তাতে চড়তে সাহস পাননি। পরে উপায়ন্তর না দেখে রিকশা ভাড়া করে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো রিকশাই দুশ’ টাকার নিচে দিলকুশা যেতে রাজি হয়নি। দীর্ঘসময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে গায়ের কাপড়-চোপড় পুরোপুরি ভিজে যাওয়ায় নূসরাত জাহান পরে অফিসে না গিয়ে বাসায় ফিরে যান।
একই ধরনের অভিযোগ জানিয়ে দক্ষিণ বাড্ডার বাসিন্দা বীমা কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম জানান, প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসের দেখা না পেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে তিনি সিএনজি অটোরিকশায় করে কাকরাইলের অফিসে গেছেন। তবে জলাবদ্ধ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি দীর্ঘসময় আটকে থাকায় নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি।
এদিকে রাজধানীর বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনে কাজ করছে সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা। ঢাকা-উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় কোথাও জলাবদ্ধতা হলে বা পানি জমে থাকলে হটলাইনে যোগাযোগ করার (১৬১০৬) আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
ডিএসসিসি এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯১টি দল (প্রতি দলে পাঁচজন কর্মী) মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ঢাকা প্রতিনিধি মো: মাসুদ রানা খন্দকার। #
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.