বিরোধী গোষ্ঠীর চাপ আর ইরান নিয়ে অনিশ্চয়তায় হামাসের টিকে থাকার লড়াই

বিটিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে দেড় বছরের বেশি সময়ে অনেক নেতাকে হারিয়েছে হামাস, ধ্বংস হয়েছে টানেল নেটওয়ার্ক, সেইসঙ্গে মিত্র ইরানের সহায়তাও এখন অনিশ্চিত।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চাপে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে।
হামাসের তিনটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স লিখেছে, যতদিন সম্ভব টিকে থাকার নির্দেশে নিজেদের মত করে লড়াই করছে হামাস যোদ্ধারা। কিন্তু তাদের বিরোধী স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েলের প্রকাশ্যে সমর্থনের কারণে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে হামাস।
একটি সূত্র বলছে, গাজায় মানবিক সংকটের কারণে যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। আর হামাসের জন্যও সংঘাতে বিরতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধবিরতি কেবল ক্লান্ত গাজাবাসীকে খানিকটা স্বস্তিই দেবে না, সেখানকার সশস্ত্র ত্রাণ লুটপাটকারী গোষ্ঠীগুলোকেও নির্মূলের সুযোগ পাবে হামাস। আসন্ন হুমকি মোকাবিলায় হামাস কিছু যোদ্ধাকে পাঠিয়েছে ইয়াসির আবু শাবাবকে হত্যার জন্য। ‘পপুলার ফোর্সেস’ এর নেতা, মাদক কারবারি আবু শাবাব গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রকাশ্যে ইসরায়েল তাদের সমর্থন দিচ্ছে। ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাফাহ এলাকায় থাকার কারণে আবু শাবাব এখন হামাসের নাগালের বাইরে।
রয়টার্স লিখেছে, তারা হামাস ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্র ও কূটনীতিকসহ ১৬টি সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছে। হামাসকে তারা এখন অত্যন্ত দুর্বল সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ব্যর্থতা সত্ত্বেও হামাস গাজায় কিছুটা প্রভাব ও কার্যক্রম ধরে রেখেছে, কিন্তু গোষ্ঠীটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
হামাস এখনও হামলা চালাতে সক্ষম। বুধবার গাজার দক্ষিণে তাদের আক্রমণে সাত ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়জন কূটনীতিক বলছেন, হামাসের কেন্দ্রীয় কমান্ড আর নেই। তারা সীমিত ও আকস্মিক আক্রমণ চালাতে পারছে।
ইসরায়েলি একজন সামরিক কর্মকর্তা বলছেন, তাদের বাহিনী ২০ হাজার বা এর বেশি হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে বলে তার ধারণা। কয়েকশ মাইল টানেল ধ্বংস বা ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলেছে। এক বছর ৮ মাস ধরে চালানো আক্রমণে গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েলের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলছেন, হামাস যোদ্ধাদের গড় বয়স আরও কমছে। অর্থাৎ সিনিয়র নেতাদের হত্যার কারণে সশস্ত্র এ গোষ্ঠীতে এখন তরুণ নেতৃত্ব ও যোদ্ধারা রয়েছেন। দরিদ্র, বেকার ও বাস্তুহীন তরুণদের তারা নিয়োগ করছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে কতজন যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন, সেটি প্রকাশ করেনি হামাস।
গাজার ৫৭ বছর বয়সী নির্মাণ শ্রমিক এসাম বলেন, “হামাস যোদ্ধারা লুকিয়ে থাকছে। কারণ তাদের ওপর বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। যেখানে-সেখানে তারা হাজির হচ্ছে, বেকারির সামনে লাইন দিচ্ছে, ত্রাণের ট্রাক রক্ষা করছে অথবা অপরাধীদের শাস্তি দিচ্ছে।”
এসাম বলেন, তারা সংঘাতের আগের অবস্থায় নেই, কিন্তু তারা টিকে আছে।
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সামি আবু জুহরি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করতে একটি চুক্তির জন্য তারা কাজ করছেন। কিন্তু আত্মসমর্পণ কোনো বিকল্প নয়।
হামাস সমঝোতার কথা বলছে। একই সময়ে সব বন্দিকে মুক্তি দিতেও তারা প্রস্তুত। তারা চায় গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হোক।
‘পরিস্থিতি ভালো দেখাচ্ছে না’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আক্রমণ চালায় হামাস। ইসরায়েলের হিসাবে, ওই আক্রমণে তাদের ১ হাজার ২০০ জন মারা গেছে। জিম্মি করা হয় ২৫৩ জনকে। এরপর থেকে অব্যাহত হামলা চালিয়েছে গাজার চেহারা পাল্টে দিয়েছে ইসরায়েল।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাবে, নারী ও শিশুসহ এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে হামাস হামলা-আক্রমণে যে ক্ষতি দেখেছে, গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ তার সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। গাজায় সবশেষ সংঘাতে বেশিরভাগ শীর্ষ সামরিক কমান্ডার হারিয়েছে হামাস। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হামাস ক্রমান্বয়ে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ গোষ্ঠীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। অবশেষে ২০০৭ সালে ফাতাহ গোষ্ঠীর কাছ থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর মনোযোগ ফিরেছে গাজার দিকে। সেখানে গাজা চুক্তির সম্ভাবনা কথা বলা হচ্ছে, যাতে সংঘাতের অবসান ও হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি মিলতে পারে।
হামাস ঘনিষ্ঠ একজন রয়টার্সকে বলেন, তারা গাজায় প্রভাব বিস্তারকারী স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবেলা করতে কয়েক মাসের জন্য হলেও যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানাবে।
তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর শর্ত রয়েছে সব হামাস নেতাকে গাজা ছাড়তে হবে, যার মানে সম্পূর্ণ পরাজয়। আর হামাস কখনও আত্মসমর্পণ করবে না।
তার কথায়, “আমরা বিশ্বাস রাখি (যুদ্ধবিরতির), কিন্তু পরিস্থিতি ভালো দেখাচ্ছে না।”
বৈরুতে কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের সিনিয়র ফেলো ইয়েজিদ সায়িগ মনে করেন, হামাস কেবল টিকে থাকারই চেষ্টা করছে। সেটি কেবল সামরিকভাবে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জই না, সর্বোপরি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও।
“যুদ্ধ বন্ধ না হলে গাজার মাটিতে তাদের নির্মূল হওয়ার মুখে পড়তে হবে। সেইসঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে গাজায় নতুন কোনো শাসনের সূত্রপাত ঘটলেও তাদের একই পরিণতি হবে।”
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো হামাসকে মোকাবিলায় ইসরায়েলের কৌশল হিসেবে কাজ করছে। নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে বলেছেন, ইসরায়েলে হামাসের বিরোধিতাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। তবে কোন গোষ্ঠীগুলোকে দিচ্ছে, সেটি বলেননি।
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে আবু শাবাবের কাছ থেকে। ফিলিস্তিনি এ বেদুঈন রয়েছেন রাফাহ এলাকায়, যেটি এখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।
হামাস আবু শাবাবকে জীবন্ত বা মৃত, যেকোনোভাবে হোক ধরতে চায়। তার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সহযোগিতা ও আক্রমণ পরিকল্পনার অভিযোগ করছে হামাস।
আবু শাবাব পূর্ব রাফা নিয়ন্ত্রণ করেন। রাফার বড় এলাকাজুড়ে তার গোষ্ঠীর সদস্যদের চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। ফেইসবুকে তাদের সশস্ত্র সদস্যদের কেরেম শালোম ক্রসিং থেকে ত্রাণের ট্রাক প্রবেশের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
গোষ্ঠীটি ওই এলাকায় স্বাধীন শাসন গড়ে তুলতে চায়; যদিও তারা বলছে শাসন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হতে তারা চায় না। তারা গাজার অন্যান্য অঞ্চলে বাস করা রাফাহর বাসিন্দাদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে। তারা খাদ্য ও আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে আবু শাবাবের গোষ্ঠীটি ইসরায়েলের সহযোগিতা বা ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছে। নিজেদের জনপ্রিয় বাহিনী বর্ণনা করে বলছে, তারা লুটপাট থেকে ত্রাণের ট্রাকগুলো রক্ষা করছে।
হামাসের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভিন্নমত দমনের অভিযোগ করছে তারা।
হামাসের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ইয়াসির আবু শাবাবের গোষ্ঠীকে সমূলে উৎপাটন করতে তারা লৌহমুষ্টি দিয়ে আঘাত করবেন। কোনো দয়া বা দ্বিধা করবেন না। শাবাবের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ করেন তিনি।
তবে গাজার সব গোষ্ঠীর সঙ্গে হামাসের বিরোধ নেই। বৃহস্পতিবার একটি গোষ্ঠী জোট বলেছে, তাদের লোকেরা উত্তর গাজায় লুটপাট থেকে ত্রাণের ট্রাকগুলোকে রক্ষা করেছে। হামাস ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ওই জোটটির কর্মকাণ্ডে অনুমোদন বা সায় দিয়েছে হামাস।
ইসরায়েল বলছে, হামাস যোদ্ধারা ত্রাণের ট্রাকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে সেই গোষ্ঠী ও হামাস বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে।
‘ইরান নিয়ে অনিশ্চয়তা’
ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আকরাম আতাউল্লাহ বলছেন, হামাসের দুর্বলতার ফলেই আবু শাবাবের আবির্ভাব। তবে শেষমেষ তিনি ব্যর্থই হবেন। কারণ ইসরায়েলকে সহযোগিতা বা সমন্বয়কারী যে কারও বিরোধিতা করে ফিলিস্তিনিরা।
তা সত্ত্বেও আবু শাবাবের দল যত ছোটই হোক না কেন, একই সংস্কৃতির শত্রু থাকা হামাসের জন্য বিপজ্জনক। আকরাম আতাউল্লাহ বলেন, “যতক্ষণ এটিকে মোকাবেলা করা না হয়, ততক্ষণ সেটি হুমকি হিসেবেই থেকে যাবে।”
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ হামাসের সামনে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হামাসের প্রতি তেহরানের সমর্থন তার সশস্ত্র শাখাকে ইসরায়েলের গভীরে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সক্ষম বাহিনীতে পরিণত করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
যুদ্ধে ইরান-ইসরায়েল উভয়েই নিজেদের বিজয়ী দাবি করেছে। নেতানিয়াহু রোববার ইঙ্গিত দেন, তেহরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযান গাজায় তার হাত আরও শক্তিশালী করেছে। তিনি বলেন, “এটি আমাদের বিজয় ও সমস্ত জিম্মিদের মুক্তি ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বুধবার বলেন, গাজায় বিশাল অগ্রগতি হচ্ছে। ইরানের উপর হামলা জিম্মিদের মুক্তি পেতে সহায়তা করবে।
হামাস ঘনিষ্ঠ এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, ইরানের সমর্থন কমে যাওয়ার ঝুঁকি মূল্যায়ন করছে হামাস। ইরানের তহবিল ও প্রশিক্ষণের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইরানে ইসরায়েলের অভিযানের আরেকটি লক্ষ্য ছিল হামাসের সঙ্গে সমন্বয়ের তত্ত্বাবধান করা বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এক কর্মকর্তা। ইসরায়েলের দাবি, সায়িদ ইজাদি নামে একজন ইরান-হামাস সম্পর্কের পেছনে ছিলেন, যার মৃত্যু ঘোষণা করা হয়েছে গত শনিবার।
হামাস বৃহস্পতিবার ইরানের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ইজাদিকে একজন বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছ। রয়টার্সকে একটি সূত্র বলছে, ইজাদি হামাসের সক্ষমতা উন্নয়নে সহায়তা করেছিলেন।
ইসরায়েলের অভিযানে কীভাবে হামাসের প্রতি ইরানের সহযোগিতার প্রভাব পড়বে, এ প্রশ্নে হামাস নেতা আবু জুহরি বলেন, ইরান বড় এবং শক্তিশালী দেশ, যেটি পরাজিত হবে না।
‘আবু শাবাব নির্ভরতা নিয়ে হতাশা’
গাজায় হামাসকে দমনের অংশ হিসেবে আবু শাবাবের দলবল ব্যবহার করছে ইসরায়েল। তবে এই গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরতা ইসরায়েলি বাহিনীকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাবে বলে সতর্ক করেছে দেশটির একটি সংবাদমাধ্যম।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র ইয়েদিওথো আরোনথ বলছে, ইসরায়েলের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না আবু শাবাবের দল। গোষ্ঠীটির ৪০০ সদস্য রয়েছে, যারা রাফার কাছে বাফার জোনে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এখনও সংকীর্ণ ওই এলাকার বাইরে তারা যেতে পারেনি। অর্থাৎ ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত রাফার বাইরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.