বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন – সুমন রহমান

ইব্রাহিম খলিল শিমুল, নোয়াখালী: “বাবাকে আমরা বলি আব্বা”
আমাদের আব্বার ছেলে মেয়ের সংখ্যা শুনে ভদ্রলোকেরা বিস্মিত চোখ কপালে তোলেন। তাদের এই বা কী দোষ! আটজন কি সংখ্যায় কম? মাঝেমাঝে আমার মনে হয় কেবল জন্ম দেওয়া ছাড়া আব্বা আমাদের আর কিছুই দিতে পারেন নি। না বেলুন, না ঘুড়ি, না শাপলা-শালুক। রাক্ষস আর রাজকন্যার গল্প বলা এমন একটি রাতও নেই যা কিনা একান্তই আব্বার আর আমাদের! কেননা আমাদের আব্বার কোন গল্প নেই।
কলেজে পড়ার সময় একবার এক লিকলিকে ফর্সা মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার বাবার কি করা হয়?” আমি অস্ফূট শব্দে বললাম,”কাজ- কাজ করা হয়।”
মেয়েটি আবার বলল, “কি কাজ?”
আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। সত্যি তো! আব্বা কি কাজ করেন? সকালে ঘুম থেকে উঠে আব্বাকে কখনো বাড়িতে দেখিনি। আম্মার কাছে শুনেছি তিনি মাঠে গেছেন। সেখানে, সবুজ শস্যের মাঠে আব্বা ব্যস্ত থাকেন সারাটা সকাল!
আব্বাকে দেখেছি শ্রাবণের বৃষ্টিতে নিমগ্ন রূপশাইল ধানের ক্ষেতে। আব্বাকে দেখেছি দুপুর রোদে কাস্তে হাতে পরিশ্রান্ত।
একে ঠিক কি বলা যায়?
আমার আব্বা শিল্পী- ‘শস্যের শিল্পী!’ দুহাতে ফসল ফলান অবিশ্রান্ত! আমাদের আব্বা ধ্যানী- মাঠের মায়ায় তার নির্বাণ! আমাদের আব্বা কর্মী- ছয় বছর বয়স থেকে কাজ করেন, ছয়শ বছর ধরে কাজ করে যাবেন!
একবার আমার প্রিয় বন্ধু অনির্বাণকে বললাম, “চল নিঝুম দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।” সে বললো, “বেশ তো।” বিকেলে বাড়ি থেকে ফিরে এসে অনির্বাণ আবার বলল, “নারে দোস্ত আমারে বাদ দে। আব্বু টের পেলে আস্ত রাখবে না।” আমার বন্ধুরা তাদের আব্বারদের এরকম ভয় পায়।
কিন্তু আমাদের আব্বাকে আমরা একদমই ভয় পাইনা। বরং আমার মনে হয় উল্টা আমাদের আব্বাই আমাদের ভয় পান। বাড়িতে আমার কোন বন্ধু এলে আব্বা কেমন যেন চুপসে যান। পাছে তার কোমরে গিঁট দেওয়া ছেঁড়া লুঙ্গি, তরকারির ঝোল লাগা পুরনো পাঞ্জাবি কেউ দেখে ফেলে! পাছে তার দুঃখের দাগ আর পরিশ্রান্ত শরীরের ঘামের গন্ধ কেউ টের পেয়ে যায়!
আমি অনেক দিন একা একা হিসেব করে দেখেছি আমাদের আব্বার কোন বন্ধু নেই। দুর্দিন, দুঃসময়ে যার মুখ মনে আসে। যাকে বলা যায় একান্ত কোন গোপন কথা।
আমি অনেকদিন তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি আমাদের আব্বার ব্যক্তিগত কোনো দেরাজ নেই।
যেখানে যত্ন করে তুলে রাখবে ছেলেবেলার ছবি আর চিঠি- কোন প্রিয় বন্ধুর অথবা প্রথম প্রেয়সীর। যে চিঠিতে একশোবার লেখা থাকবে- ভালোবাসি! ভালোবাসি! কোন পিদিম জ্বালা বর্ষা রাতে যে চিঠি পড়তে পড়তে আব্বা চোখে জল নামবে! আমাদের আব্বা অর্থনৈতিক বোঝেন না বুঝেন নাকি কিসে মে বেড়ে যায় পুরান চাল আর পেঁয়াজের দাম।
আমাদের আব্বা কোন নায়িকার নাম জানেন না। জানেন না হোমারের কবিতায় কি এমন আছে কারুকাজ! তিনি শুধু জানেন প্রতি সোমবার শেফালী আপা আসেন, প্রতি সোমবার ঋণের কিস্তি। তিনি শুধু জানেন তাঁর কিশোরী মেয়েটি খুব দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে!
আব্বার জন্য আমার কোনদিন মন খারাপ হয়নি। আহত প্রজাপতির জন্যে আমি প্রার্থনায় নত হয়েছি। ঠান্ডা শীতের রাতে একটা সরপুঁটি মাছের জন্য আমার মায়া হয়েছে। দুপুর রোদে একাকী একটা দাঁড় কাকের জন্য আমার মন খারাপ হয়েছে ভীষণ। কিন্তু আবার জন্য আমার কোনদিন মন খারাপ হয়নি। কেননা আমাদের আব্বা তোর সবকিছু নন। আমাদের আব্বা তো শুধুই আমাদের আব্বা- এখনো উড়োজাহাজ দেখে অবাক তাকিয়ে থাকেন! যখনই আব্বার কথা ভাবি, আমার মনে পড়ে সীতাকান্ত মহাপ্রাণের “লেবু গাছ”  কবিতাটি-
“লেবু গাছে, ও লেবু গাছ:
আমার সামনের জন্মে আমি ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে, উঠে চলে যাবে না। তোমার ভিতরে যে থাকে, সেই মৃত্যুদূত কে বলবে ছোট ছেলেটা এমন অদ্ভুত এক অনুরোধ করে গেছে যা ফেলা যায় না।”
আজ কাল আমার প্রায়ই মনে হয় আমাদের আব্বা যেন সেই পুরনো শরবতী লেবু গাছ, যার পাতা আর পরাগের ঘ্রাণ আমার চেনা। অথচ এত কাছাকাছি থেকেও ভালোবাসার চুক্তি তেমন তাকাইনি কোনদিন!~আমাদের আব্বাকে নিয়ে বড় ভাইয়া Omar Faruk এর লেখা “কেউ দেখে না একলা মানুষ!” নামে বই প্রকাশিত করেছেন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নোয়াখালী প্রতিনিধি ইব্রাহিম খলিল (শিমুল)। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.