বাগেরহাটপ্রতিনিধি: সাদাসোনা খ্যাত বাগেরহাটের বাগদা চিংড়ি ঘেরে মড়ক লেগে চিংড়ি মারা যাচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতিরমূখে পড়েছে চাষিরা। প্রচন্ড তাপদাহ, অনাবৃষ্টি, ভাইরাস, অপরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ ও হ্যাচারির অপুষ্ট পোনা ছাড়ার কারনে বাগদা চিংড়িতে মড়ক লেগেছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছে।
তবে চিংড়ির এই মড়কে রপ্তানি আয়ে কোন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে মৎস্য বিভাগ। গত এক মাস ধরে এই জেলার বাগদা চিংড়ি ঘেরে চিংড়ি মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা চিংড়ির জন্য বিখ্যাত। এরমধ্যে বাগেরহাট জেলা অন্যতম। এই খ্যাতে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১২ থেকে ১৫ ভাগ আসে বাগেরহাট থেকে।
ঘেরে জাল ফেললে তাতে মরা বাগদা চিংড়ি উঠে আসছে। মরে যাওয়া চিংড়ি লাল বর্ণ ধারণ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগেরহাটের নয় উপজেলাতেই কমবেশি বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি মরছে জেলার রামপাল ও মোংলা উপজেলাতে। এই দুই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৯০ ভাগ ঘেরের বাগদা চিংড়ি মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে চাষী ও মৎস্য বিভাগ।
বাগেরহাট জেলায় নয় উপজেলাতেই কমবেশি চিংড়ি চাষ হয়। জেলায় ৬৬ হাজার একর জমিতে মাছের ঘের রয়েছে। ঘেরের সংখ্যা ৭৩ হাজার।
চাষী আদিল শেখ বিটিসি নিউজকে বলেন, তিন বিঘার দুটি ঘেরে তিন লাখ টাকা খরচ করে মাছ ছাড়ি। এপর্যন্ত আমি হাজার বিশেক টাকা মাছ ধরে বিক্রি করেছি। সম্প্রতি আমার ঘেরে ভাইরাস লেগে মাছ মরে গেছে। সময়মত পানি না পাওয়া ও পানিতে অতিরিক্ত লবন থাকার মাছ মারা গেছে। এছাড়া এবছর বৃষ্টিও নেই। এবছর আমার খরচের টাকাই উঠবে না।
রাখাল বিশ্বাস বিটিসি নিউজকে বলেন, দেড় বিঘা জমিতে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে চিংড়ি চাষ করেছিলাম। আমি এখনো এক টাকার মাছও ধরতে পারিনি। হ্যাচারির খারাপ পোনা ছাড়ার কারনেই মনে হয় সব মাছ মরে গেছে। বর্তমানে হ্যাচারির পোনার মান ভাল না। পোনার মান ঠিক রাখতে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান এই চাষী।
আরেক চাষী নাজমুল শেখ বলেন, দেড় বিঘা জমিতে ৫০ হাজার টাকা মাছ ছেড়েছিলাম। ঘেরে এখন কোন মাছ পাচ্ছিনা। পানিতে অতিরিক্ত লবন ও অনাবৃষ্টির কারনে ঘেরের মাছ মারা গেছে। ধারদেনা করে ঘেরে মাছ চাষ করেছি। এখন মাছ মারা গেলে ধারদেনা শোধ করব কিভাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এই চাষী।
মোস্তফা শিকদার বিটিসি নিউজকে বলেন, তিন এক জমিতে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে বাগদা চিংড়ি চাষ করেছি। ঘেরে মড়ক লেগে সব মাছ মারা গেছে। সময়মত বৃষ্টি না হওয়া ও লবন পানির কারনে মাছ মরে যায়। এই এলাকায় দুইশ’র বেশি মানুষ মাছের চাষ করে। আমার একার না এই এলাকার অধিকাংশ ঘেরের মাছ মরে গেছে। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ এই ঘেরের উপর নির্ভরশীল। ঘেরের আয় দিয়ে আমাদের চলতে হয়। ঘেরে আমরা যে হ্যাচারির বাগদার পোনা ছাড়ি তা অপুষ্ট। এই পোনার মান ভাল কি মন্দ তার উপর সরকারের কোন নজরদারি নেই। হ্যাচারি মালিকরা যা বাজারে বিক্রি করছে আমরা তাই কিনে এনে ঘেরে ছাড়ছি। অপুষ্ট রোগাক্রান্ত পোনার কারনে এই মড়ক লেগে থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞরাই ভাল বলতে পারবে। তাই পোনার বিষয়ে সরকারের উচিত হ্যাচারিগুলোর উপর নজরদারি করা। চিংড়ি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এই চাষী।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) এ এস এম রাসেল বিটিসি নিউজকে বলেন, বাগেরহাট জেলার নয় উপজেলাতেই চিংড়ি চাষ হয়। সম্প্রতি সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে জেলার মোংলা ও রামপাল উপজেলাতে অস্বাভাবিকহারে চিংড়ি মারা যাচ্ছে।
এরমধ্যে রামপাল উপজেলার চারটি ইউনিয়ন এবং মোংলার দুটি ইউনিয়নে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে গত এক মাস ধরে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রী পর্যন্ত ওঠানামা করছে। একারনে ঘেরের চিংড়ি অস্বাভাবিকহারে মারা যাচ্ছে।
এছাড়া চাষীদের ঘেরে নিন্মমানের পোনা ছাড়া কারনেও মাছ মরে যাচ্ছে বলে ধারনা করছি। আমরা চাষীর মারা যাওয়া চিংড়ি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারে পাঠিয়েছি। তাদের প্রতিবেদন হাতে পেলে চিংড়ি মারা যাওয়ার সঠিক কারন জানা যাবে। আমরা জেলা ও উপজেলার থেকে চাষীদের নানা পরামর্শ দিয়ে আসছি। ঘেরের পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে চাষীদের বলা হচ্ছে। তারা যখন ঘেরে পোনা ছাড়বে অবশ্যই যেন তা পকেট ঘেরে পরিচর্যা করে ছাড়ে সেই পরামর্শ তাদের দিচ্ছি। এই পরামর্শ মেনে চললে চাষীর ঘেরের চিংড়ি মরে যাওয়া কমে আসবে। আমরা সম্প্রতি সময়ে ঘেরের পানির তাপমাত্রা পরিমাপ করে দেখেছি তাতে তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৯ ডিগ্রী রয়েছে।
এটি বাগদা চিংড়ির মারা যাওয়ার অন্যতম কারন। তাই তাদের ঘেরে পানি বেশি রাখতে তিন থেকে চার ফুট গভীরতা রাখতে বলি। বাগেরহাট জেলার সব উপজেলাতেই কমবেশি চিংড়ি মারা যাচ্ছে, তবে রামপালের চারটি ও মোংলার দুটি ইউনিয়নের ৯০ ভাগ ঘেরের চিংড়ি মারা গেছে।
বাগেরহাট জেলায় শতকরা ৫ থেকে দশ শতাংশ ঘেরের চিংড়ি মারা গেছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। চিংড়িতে মড়ক লাগায় চলতি অর্থ বছরে রপ্তানি আয়ে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না, কারন এখন মাত্র চিংড়ির মৌসুম শুরু হয়েছে। আগামীতে নতুন করে পোনা ছেড়ে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.