বাগমারা প্রতিনিধি: রাজশাহীর বাগমারায় ওমর ফারুক ওরফে ধলু (৩৮) নামে এক ভ্যানচালককে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। নিহত ফারুক ভবানীগঞ্জ পৌরসভার চানপাড়া মহল্লার মসলেম সরদারের ছেলে।
গত ১৭ ডিসেম্বর ভ্যান চালক ফারুককে চুরির অপবাদে তাকে প্রকাশ্যে উলঙ্গ করে দুই ঘণ্টা ধরে লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়। সন্ধ্যায় উপজেলা সদরের সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সদস্যরা মধ্যযুগীয় এই পাশবিকতা চালানোর দাবি করা হয়েছে। নির্যাতনের তার হাত-পায়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় লোহার পেরেক দিয়ে নির্যতন করা হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষে অভিযোগ করা হয়। পরে তাকে ‘মাদকের নাটক সাজিয়ে’ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
শনিবার ভোরে কারা হেফাজতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরিবারের পক্ষে তারা এমন নির্মম হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
তবে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যান্ত থানায় কোন মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুল আলম। এদিকে তাকে নির্যাতনের বিষয় অস্বীকার করেছেন অভিুক্তরা। এই ঘটনায় সন্দেহ ভাজন দুই জনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে থানার ওসি আটকের বিষয়টি নিশ্চত করেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই ঘটনায় মঙ্গলবার বাগমারা থানা পুলিশ ভবানীগঞ্জ পৌরসভার দানগাছি মহল্লায় অভিযান চালিয়ে মুকুল হোসেন ওরফে মুরগি মুকুল (৪৪) এবং একই মহল্লার জুয়েল রানা ওরফে ভাংড়ি জুয়েল (৩৫) কে আটক করেছে।
বাগমারা থানার ওসি সাইদুল আলম জানান, আমরা মামলা গ্রহনের জন্য নিহত ভ্যান চালকের পিতা মসলেম সরদারকে থানার আসার জন্য খবর পাঠালে তিনি এখনও থানায় সন্ধ্যা পর্যন্ত আসেননি। তিনি আসলে মামলা গ্রহন করা হবে। তবে এই ঘটনায় পুলিশের কোন দায়িত্ব অবহেলা নেই বলে তিনি দাবী করেছেন।
এদিকে এই ঘটনায় একটি পক্ষ মামলা ও আসামী বানিজ্যে মেতে ওঠেছে। ইতিমধ্যে ওই মামলায় আসামী করা না করা নিয়ে ব্যাপক চাঁদাবাজিও শুরু হয়েছে। এই পক্ষও আবার নিহত ভ্যান চালকের পিতা মসলেম সরদারকে নানা ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলার বাদী হতে নিষেধ করছে এবং তাকে নানান ভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে
ঘটনাস্থল ভবানীগঞ্জ পৌরসভা সদরের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ভ্যানচালক ফারুক বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি সিএনজি স্ট্যান্ডের সামনে তার ভ্যানটি রেখে প্রস্রাব করতে যান। ফিরে এলে চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে আটকান সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন।
এরপর রেজাউল ও মতিনসহ সমিতির সদস্য হান্নান, বিপ্লব, রফিক, মোজাম্মেলসহ ১০-১৫ জন ফারুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাকে লোহার রড দিয়ে পেটাতে থাকেন। একপর্যায়ে ফারুক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর তাকে পাশের একটি প্রাচীরের সঙ্গে দাঁড় করানো হয়।
একপর্যায়ে ফারুকের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে রেজাউল বাগমারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশের একটি টিম এসে ফারুকের শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর বাগমারা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম ভুঞাকে ফোন দেওয়া হলে তিনি সেখানে আসেন। পরে ফারুকের কাছে মাদক পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি তাকে কারাগারে পাঠান।
সাইফুল ইসলাম ভুঞা বলেন, ফারুকের কাছে এক পুরিয়া গাঁজা পাওয়া গেছে। এ কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে সাত দিনের কারাদÐ ও একশ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে তাকে মারধর করা হয়েছে কিনা সেটি আমি জানি না। পরে শুনেছি, তিনি অসুস্থ। এ কারণে আমি তার চিকিৎসার জন্য রাজশাহী কারাগারের ডেপুটি জেলারকে অনুরোধ করেছি। তবে এই ঘটনায় সাইফুল ইসলাম ভুঞা তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ অস্বিকার করেছেন।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ার পর পুলিশের গাড়িতে ফারুককে রাজশাহী কারাগারে নেওয়া হয়নি; বরং সমিতির সিএনজিতে পুলিশের পাহারায় তাকে প্রথমে বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পর রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে রাজশাহী কারাগারে পৌঁছে দেওয়া হয়।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহ আলম খান বলেন, আমরা ফারুককে আহত অবস্থায় গ্রহণ করি। তার শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল। তাকে গ্রহণের সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সার্টিফেকেটেও বিষয়টি উল্লেখ ছিল। শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হলে পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর সকালে রামেক হাসপাতালের ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শনিবার ভোর ৫টার দিকে হাসপাতালে পুলিশ ও কারারক্ষীদের হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফারুক মারা যান। ময়নাতদন্তের পর তার লাশ নিকটাত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নিহত ফারুকের বাবা মসলেম সরদারও ভ্যান চালান। তিনি বলেন, আমরা যখন খবর পাই, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সিএনজি স্ট্যান্ডে গিয়ে আর ফারুককে পাইনি। তাকে তখন সেখান থেকে নিয়ে চলে গেছে। পরে মানুষের কাছে শুনি, ফারুককে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনি এ হত্যার বিচার দাবি করেছেন এবং তাকে মামলা না করার হন্য নানান ভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
ফারুকের নির্মম হত্যাকান্ডের পর পাগলপ্রায় তার মা পারুল বেগম। তিনি বলেন, আমার মাত্র দুটি ছেলে-মেয়ে। ফারুকের ১৩ বছর বয়সি একটি ছেলে আছে। আমার ফারুককে চরম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। পানিও খেতে দেয়নি। আমরা গরিব মানুষ। কার কাছে যাব, কার কাছে বিচার চাইব।
হাফিজুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান নামে দুই প্রতিবেশী ফারুকের লাশ গোসল করান। হাফিজুল জানান, ফারুকের শরীরে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে আঘাত করা হয়নি।
তবে মারধরের অভিযোগ প্রথমে অস্বীকার করেন ভবানীগঞ্জ সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম। তিনি বলেন, মারধরের সময় আমি রাজশাহীতে ছিলাম। শুনেছি চুরি করার কারণে ফারুককে মেরেছে লোকজন। চুরির অপরাধে এর আগে চারবার ধরা পড়েছে ফারুক। তাকে গাঁজাসহ লোকজন ধরেছে। আমি দেখেছি।
ঘটনার সময় আপনি তো রাজশাহীতে ছিলেন না, কীভাবে দেখলেন-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি খবর পেয়ে পরে সেখানে গেছি। কারা মেরেছে আমি বলতে পারব না।
বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুল ইসলাম বলেন, নির্যাতনের বিষয়টি পুলিশ জানত না। আহত ফারুককে পুলিশের গ্রহণে অস্বীকৃতির বিষয়টি সঠিক নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত হলে সেখানে নিয়মানুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ সদস্যরা যান। আহত ফারুককে আমাদের গাড়ি সংকটের কারণে সিএনজিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বাগমারা প্রতিনিধি মো: আফাজ্জল হোসেন / রাজশাহী। #















