বড় বিস্ফোরণ-ঝুঁকিতে ঢাকা শহর

বিশেষ প্রতিনিধি: গুলশানের একটি বাড়িতে ১৫ দিন আগে বিস্ফোরণের পর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সূচনা হয়। ওই ঘটনায় একজনের প্রাণহানি হলেও বিপুল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। আর গত তিন দিনের মধ্যে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে দুটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে। এতে ভবন ধসে পড়ে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। একটির রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ঘটনা। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকা শহরের ভবনগুলো মানুষের বসবাসের জন্য কতটা নিরাপদ, সেই প্রশ্নটিও এখন সামনে চলে এসেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শহরের ভবনগুলোর অভ্যন্তরীণ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ লাইনগুলো নিয়মিত পরিচর্যা না করার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁঁকি তৈরি হচ্ছে। আবার স্যুয়ারেজের লাইনগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সেপটিক ট্যাংকে গ্যাস জমে যাচ্ছে। অন্যদিকে নিম্নমানের এসি এবং বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব বিষয়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা সেবা সংস্থাগুলোর। কিন্তু তারাও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। একটার রেশ না কাটতেই আরেকটি বিস্ফোরণের ঘটনা হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এখনো ঢাকা শহর এ ধরনের বড় বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় এই বিস্ফোরণের ঝুঁঁকি সবচেয়ে বেশি। সেখানকার ইউটিলিটি সার্ভিস পুরনো। দাহ্য-বিপজ্জনক পদার্থ গুদামজাত করা হয়। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কোনোভাবেই এড়ানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাতেই আবদ্ধ ময়লা-আবর্জনা দ্রুত পচে তৈরি হচ্ছে মিথেন গ্যাস। ড্রেনের মলমূত্র থেকে তৈরি হওয়া বাতাসের চেয়ে হালকা এই গ্যাস পাইপ দিয়ে ঢুকছে বাসাবাড়িতে। লাইনের গ্যাসের লিকেজ থেকেও গ্যাস জমছে ঘরে। সেই গ্যাস জমা হচ্ছে ঘরের সিলিংসহ আবদ্ধ স্থানে। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না থাকায় এসব গ্যাস বের হতে পারছে না ঘর থেকে। ফলে রাজধানীর ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের গ্যাসবোমা। সামান্য আগুন কিংবা শর্টসার্কিটে মিথেন গ্যাস অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে বিপুল শক্তি তৈরি করে মুহূর্তে ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করছে। সেফটিক ট্যাংক ও রিজার্ভ ট্যাংকে জমে থাকা গ্যাস থেকেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদরা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসনাত  বিটিসি নিউজকে বলেন, বাসার ভেতরে কিংবা বাসার বাইরের ময়লা-আর্বজনা পচে মিথেন গ্যাস তৈরি হচ্ছে। পয়ঃনিষ্কাশন লাইন থেকেও মিথেন গ্যাস আসতে পারে। এই গ্যাস আবদ্ধ ঘরে কিংবা সিলিংয়ের ভেতর জমা হয়। আগুন জ্বালালে কিংবা বৈদ্যুতিক লাইনে সামান্য পরিমাণ স্পার্ক হলেই সঙ্গে সঙ্গে মিথেনের সঙ্গে অক্সিজেনের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস, জলীয় বাষ্প ও বিপুল তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, যা মুহূর্তেই ধ্বংসলীলা চালিয়ে দেয়।
শক্তির পরিমাণ হিসাবে তিনি বলেন, মাত্র ১৬ গ্রাম মিথেন পুড়ে ৮৯০ কিলোজুল পর্যন্ত শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। মিথেন গ্যাসের এই বিপুল শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতাই বড় ধরনের বিস্ফোরণের কারণ। এটা থেকে বাঁচতে হলে বাসাবাড়ির ভেল্টিলেশন বাড়াতে হবে। ঘরের বাতাস যাতে বাইরে যায় সেই পদ্ধতি বাড়াতে হবে। আর বাসার নিচতলায় যেহেতু মিথেন গ্যাস বেশি জমে, তাই সেখানে গ্যাস ডিটেক্টর লাগাতে হবে। সচেতন না হলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ থামানো যাবে না।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক এস্টেট মো. নজরুল ইসলাম বিটিসি নিউজকে বলেন, আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা অন্যায়। রাজধানীতে অনেক ভবন রয়েছে, যেগুলো আবাসিক অনুমোদন নিয়ে পরে হোটেল-রেস্তোরাঁ-অফিসের জন্য ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে সনদ নবায়ন করার কথা থাকলেও এটি অনেকে মানেননি। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবনের আবদ্ধ ঘরগুলো একেকটি গ্যাস চেম্বার হিসেবে দেখা দিয়েছে। মিথেন ও রান্নার এলপিজি গ্যাস, অক্সিজেনের সঙ্গে দাহ্য পদার্থ মিলে ভয়ানক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বিটিসি নিউজকে বলেন, ঢাকায় শুধু উন্নয়ন হয়েছে। সেবা সংস্থাগুলো ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেয়নি। নগরে শুধু সুন্দর চাকচিক্য ভবন করাই যথেষ্ট নয়। একটি নিরাপদ ও আধুনিক নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নগর ব্যবস্থাপনা কতটা শৃঙ্খল। বাংলাদেশের নগরায়ণের ব্যবস্থাপনা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল। যে সংস্থা ভবনের অনুমোদন দিচ্ছে ওই সংস্থা পরবর্তীতে আর সেই ভবন পরিদর্শন করছে না বা ভবন পরিদর্শনের পর ভবনটি ব্যবহার উপযোগী কিনা, সেটিও স্পষ্ট করে দিচ্ছে না। এখানে জবাবদিহিতার অভাব দেখা দিচ্ছে।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সাবেক প্রধান পরিদর্শক শামসুল হক বিটিসি নিউজকে বলেন, যেসব স্থানে বিস্ফোরণ ঘটে, সেখানে সাধারণের চেয়ে বিভিন্ন দাহ্য-গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকে। এসব জায়গায় ন্যাচারাল গ্যাস কিংবা মিথেন গ্যাসের উপস্থিতিও পাওয়া যায়। আবার গ্যাসের পাইপলাইনে লিকেজ থাকে। সেই গ্যাস যখন বদ্ধ অবস্থায় থাকে তখনই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, গ্যাসের পুরনো লাইন বা নানা ধরনের দাহ্য পদার্থ থেকেও বিস্ফোরণ বা আগুনের সূত্রপাত ঘটে থাকে। উন্নত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ব্যক্তিসচেতনতা বাড়াতে পারলে এসব দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা সম্ভব।
ভবনে জমে থাকা গ্যাস থেকে এসব বিস্ফোরণ হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল। সিটিটিসি জানিয়েছে, তাদের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গ্যাস ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করে বিস্ফোরণ স্থলে গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছেন। কোনো আবদ্ধ জায়গায় স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ঘনত্বের গ্যাস থাকলে বৈদ্যুতিক সুইচ, শর্টসার্কিট, দিয়াশলাই বা লাইটারসহ এ ধরনের যে কোনো কিছু থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনের নির্মাণগত কারণেও অনেক সময় কক্ষগুলোতে গ্যাসীয় অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বর্জ্য পচা গ্যাস ও লাইনের গ্যাসের পাশাপাশি তা ছাড়া বর্তমানে বাসাবাড়িতে ‘এসি’র ব্যবহার বেড়েছে। এসির কক্ষ সাধারণত পুরোপুরি বদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। সেখান থেকেও গ্যাস নিঃসৃত হতে পারে। আবার কক্ষে কোনো গ্যাসের লাইন নেই; কিন্তু তার পরও বাসা বা কক্ষে গ্যাস জমতে পারে। বাথরুমের পাইপ দিয়েও মিথেন গ্যাস আসতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বাসাবাড়িতে গ্যাসের কোনো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। গ্যাস কিংবা এ ধরনের কোনো গন্ধ নাকে এলেই সেটি ভালোভাবে বুঝে দরজা-জানালা খুলে দিয়ে কিছুটা সময় পর বৈদ্যুতিক সুইচ চালু বা পরবর্তী অন্যান্য কার্যক্রম করতে হবে। তা না হলে আবদ্ধ ঘরে গ্যাস জমলে বৈদ্যুতিক সুইচ চালু বা দিয়াশলাই জ্বালালে সেটি বোমার মতো বিস্ফোরিত হয় এবং আগুন ধরে যায়।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যে কোনো ভবনে মানহীন বৈদ্যুতিক তার, সুইচ, এসিসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিও দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গত মঙ্গলবার বিকালে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণে ২০ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে রবিবার সকালে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩ জন নিহত ও অর্ধশত আহত হয়েছেন। তার এক দিন আগে শনিবার সকালে অভিজাত এলাকা গুলশানের নিকেতনে ‘এসি’ বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গোপাল মল্লিক নামে একজন মারা গেছেন। একই দিনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। দুই বছর আগে মগবাজারে একটি চারতলা ভবন ধসে পড়েছিল বিস্ফোরণে, সেখানে নিহত হয়েছিলেন ১২ জন। এর বাইরেও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি রুহুল আমীন খন্দকার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.