ফাইনালের আগে ফাইনাল: অপ্রতিরোধ্য স্পেনের জার্মান-পরীক্ষা

বিটিসি স্পোর্টস ডেস্ক: এখনও পর্যন্ত এবারের ইউরোর সেরা দল বলা যায় স্পেনকে। আগ্রাসনের সঙ্গে নান্দনিকতা আর সৌন্দর্যের সঙ্গে কার্যকারিতা, সব কিছুর মিশেলে চোখধাঁধানো ফুটবল উপহার দিয়ে চলেছে তারা। এখনও পর্যন্ত চার ম্যাচের প্রতিটিতেই অসাধারণ ফুটবল উপহার দিয়ে অপ্রতিহত গতিতে তারা পৌঁছে গেছে কোয়ার্টার-ফাইনালে। কিন্তু এখানেই তাদের অপেক্ষায় কঠিন এক বাধা। ফাইনালের আগ পর্যন্ত যে প্রতিপক্ষকে এড়াতে চাইবে সবাই, সেই স্বাগতিক জার্মানির সঙ্গে লড়তে হবে শেষ চারে উঠতে।
ইউরোর চারটি কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ আর কৌতূহল নিঃসন্দেহে এই ম্যাচকে ঘিরেই। বলা হচ্ছে ফাইনালের আগে ফাইনাল এটি।
এই ধরনের ম্যাচে ফেভারিট বলে কিছু থাকে না সাধারণত। তবে স্পেন এবারের আসরে যেভাবে খেলছে, তাদেরকে এগিয়ে রাখলেও খুব বেশি আপত্তি থাকার কথা নয় কারও। যদিও গত কয়েকটি বড় আসরের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগোনোর ইঙ্গিত দিচ্ছে এবারের জার্মানি দল, গ্যালারি ভরা দর্শক সমর্থন তাদেরকে জোগাবে বাড়তি প্রেরণা, তবু সম্ভাবনায় একটু হলেও এগিয়ে স্পেন। লুইস দে লা ফুয়েন্তের এই দলটি এতটাই অসাধারণ।
২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত যে তিকি-তাকা ফুটবল দিয়ে পিঠেপিঠি ইউরো ও মাঝে বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল স্পেন, সময়ের পরিক্রমায় যে খেলার ধরনে মরচে পড়েছিল এবং যে ঘরানা হয়ে উঠেছিল অচল ও অকার্যকর, সেটিই ঝালাই করে নতুন রূপে মেলে ধরেছে এই স্পেন।
তিকি-তাকা ফুটবলের স্বর্ণ সময়েও অনেক সময় স্পেনের খেলা কখনও কখনও একটু মন্থর হয়ে পড়ত, কখনও একটু বেশিই পাস খেলার অভিযোগ তাদেরকে নিয়ে ছিল। পরের সময়টায় তো অতিরিক্ত পাস-নির্ভর ধারহীন দলে পরিণত হয়েছিল তারা। কিন্তু এখনকার স্পেন পুরো অন্যরকম। খেলার সেই সৌন্দর্য তাদের আছে। সঙ্গে আছে গতিময় আগ্রাসী ফুটবল, বিদ্যুৎগতির ‘ওয়ান-টাচ মুভ’ আর শাণিত ফুটবল।
এই দল শুধু পাস দেওয়ার জন্য পাস দেয় না, বরং সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পাস দিয়ে খেলাকে প্রাণবন্ত রাখে। মাঠে দলের প্রতিটি ফুটবলারের যেন পরস্পরের সম্ভাব্য অবস্থান সহজাতভাবেই জানা, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সঠিক পাস খেলে যান তারা ম্যাচজুড়ে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে দে লা ফুয়েন্তে কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই ঘরানায় খেলার চেষ্টা করছে স্পেন। শুরুতে একটু গুছিয়ে নিয়ে গত এক বছরে এভাবেই খেলে চলেছে এই দলটি। তবে সেটির সেরা রূপ দেখা যাচ্ছে এই ইউরোতে।
স্পেনকে এই চেহারায় দেখে চমকে গেছেন অনেকেই। তবে স্প্যানিশ ফুটবলকে কাছ থেকে অনুসরণ করে আসছেন যারা, তাদের জন্য এটি বড় কোনো বিস্ময় নয়। বরং যুব পর্যায়ের ফুটবলে এক দশকের যে পরিকল্পনা, সেটিরই ফসল মিলছে এখন। সেই প্রকল্পের নেপথ্য নায়ক এই দে লা ফুয়েন্তেই।
এবারের স্পেন স্কোয়াডের অর্ধেকের বেশি ফুটবলার দে লা ফুয়েন্তের কোচিংয়ে ছিলেন জাতীয় একাডেমি প্রকল্পে। বয়সভিত্তিক দলগুলির কোচ হিসেবে এক দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন দে লা ফুয়েন্তে এবং সেখানেই এই ফুটবলারদের তিনি গড়ে তুলেছেন যত্ন নিয়ে নিজের মতো করে। ইউরোপিয়ান পর্যায়ে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোয় দারুণ পারফরম্যান্সও ছিল তখন স্পেনের।
সেই দলগুলি থেকে উঠে আসা এক গাদা ফুটবলার এখন সেই কোচের তত্ত্বাবধানেই তুলে ধরেছেন জাতীয় দলের ঝান্ডা। তাদেরই একজন মিকেল মেরিনো। রেয়াল সোসিয়েদাদের ২৮ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানালেন তাদের দলের মূল শক্তির উৎস।

“এই দলের প্রায় সবাই আমরা পরস্পরকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। আমার খেলা সম্ভবত সবচেয়ে নিবিড়ভাবে আঁটসাঁট দল এটি এবং আমার মনে হয়, এটিই এই দলের সবচেয়ে বড় শক্তি- আমাদের ভাতৃত্ববোধ ও দলীয় চেতনা।”

এই বন্ধনের নেপথ্যে যথারীতি সেই দে লা ফুয়েন্তেই। বয়সভিত্তিক দলের কোচকে জাতীয় দলে পাওয়াতেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন মেরিনো।
“আমাদের জন্য এটা বিশাল এক সুবিধা। লুইস এনরিকের কোচিংয়েও জাতীয় দলে খেলেছি আমি। তবে খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের জন্য এখনকার ব্যাপারটি পুরো ভিন্ন। তিনি (দে লা ফুয়েন্তে) আমাদের সবাইকে খুব ভালো করে চেনেন এবং সবচেয়ে যেটা জরুরি, আমরা তাকে খুব ভালোভাবে চিনি। আমরা জানি, তিনি আমাদের কাছে কী চান। তিনি যে ফুটবল খেলাতে চান, কোন ধরনের মানসিকতা দরকার হয় এতে, সবকিছু আমরা জানি।”
“তাকে কোচ হিসেবে পাওয়া যেমন আমাদের জন্য দারুণ, তেমনি এটাও বড় সুবিধা যে আমাদের প্রত্যেকের খুঁটিনাটি সবকিছু তিনি জানেন। এজন্যই অন্য বেশির ভাগ জাতীয় দলের চেয়ে আমরা অনেক বেশি সম্পৃক্ত ও পরস্পরের সম্পর্ক দারুণ। এই ধরনের রসায়ন শুধু ক্লাব ফুটবলেই সাধারণত দেখা যায়।”
তবে মেরিনোদের এই বন্ধন আদতেই কতটা শক্ত, সেটি প্রমাণের বড় মঞ্চ এবারের কোয়ার্টার-ফাইনাল। শুক্রবার জার্মানির সঙ্গে লড়তে হবে তাদের। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলেও তাদের খুবই চেনা।
এই মেরিনো যেমন, দে লা ফুয়েন্তের কোচিংয়েই দুটি অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোর ফাইনালে তিনি খেলেছেন জার্মানির বিপক্ষে। ২০১৭ আসরে তারা হেরে গিয়েছিলন, কিন্তু ২০১৯ আসরে তারা শোধ তুলে নেয় ২-১ গোলে জিতে। ২০১৯ আসরের টুর্নামেন্ট সেরা ফাবিয়ান রুইস এখনকার এই জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সেই দলে খেলা মিকেল ওইয়ারসাবাল, দালি ওলমো খেলছেন এবারের ইউরোতে।
দে লা ফুয়েন্তের কোচিংয়ে ২০১৫ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ ইউরোজয়ী স্পেন দলের সদস্য ছিলেন মেরিনো, যে দলে ছিলেন মিডফিল্ডার রদ্রি ও গোলকিপার উনাই সিমনও। এছাড়াও দে লা ফুয়েন্তের কোচিংয়ে ২০২২ অলিম্পিকে সোনাজয়ী স্পেন দলের পেদ্রি, মার্তিন সুবিমেন্দি, মার্ক কুকুরেইয়া এখন খেলছেন এই ইউরোর দলে।
একইভাবে, মেরিনোদের সময়টায় জার্মানির ওইসব বয়সভিত্তিক দলে খেলা বেশ কজন এখন খেলছেন তাদের জাতীয় দলে এই ইউরোতে।
জার্মানির সঙ্গে লড়াইয়ের সেই স্মৃতিগুলো এখন দোলা দিচ্ছে মেরিনোর মনে। চ্যালেঞ্জের পরিধিও তার জানা। তবে কাজটা কঠিন বলেই তারা আরও বেশি উজ্জীবিত।
“জার্মানির বিপক্ষে খেলার দারুণ সব স্মৃতি আছে আমার। বছরের পর বছর ওদের সঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। হারি বা জিতি, ওদের সঙ্গে খেলতে নামলেই রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে।”
“আমরা জানি, এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। তারা খুব গোছানো একটি দল এবং গ্যালারি ভরা দর্শকের সমর্থনও পাবে। কাজটা কঠিন হবে আমাদের। তবে মানসিকতাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা দারুণ এককাট্টা ও একসঙ্গ শক্তিশালী, পরস্পরের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা অগাধ এবং এই চ্যালেঞ্জটাই আমরা চাই, সেরা দলের বিপক্ষে খেলতে এবং সেরাদের হারাতে।”
জার্মানি তো স্রেফ পরের ম্যাচের বাধা, শেষ পর্যন্ত সব বাধা জয় করে শিরোপা জয়ের ছবি আঁকছেন মেরিনো। এই স্বপ্নই ধাবমান রেখেছে দলকে।
“আমাদের মনোযোগ মূল লক্ষ্যে, সেটি হলো ইউরো জয় করা। এই দলে কেউ স্বার্থপর নন। আমরা সবাই চাই দলকে সাফল্য এনে দিতে, এটিই আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে দারুণ এক দলে পরিণত করেছে।” #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.