প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কুড়িগ্রামের চার দিনমজুর কারাগারে

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: পাঁচ অসহায় দিনমজুর পরিবারের ১৭ জন সদস্যের চোখে এখন শুধুই অশ্রু। কাঁদছেন তাদের আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরাও। গত ১৫ দিন ধরে খাওয়া-নাওয়াও ভুলে গেছেন তারা। একদিন কাজ না করলে যাদের পেটের ভাত জোটে না। তারা এখন শোকের মাতমে দিন পার করছেন। এসব খেটে খাওয়া দিনমজুর পরিবারের কর্তা ব্যাক্তিরা সরকারি টাকা আত্মসাৎকারী একটি প্রতারক চক্রের প্রতারনার কারনে জালে জড়িয়ে ফেঁসে গেছেন। সরকারি টাকা প্রতারণার মামলায় এখন আছেন জেল হাজতে।
গাজীপুর কারাগারে থাকা ৪ জন দিনমজুরের মধ্যে বিধবা ফুলমনি রানী (৩৭), কমল চন্দ্র রায় (৩৩), প্রভাস চন্দ্র রায় (৪৫) ও রনজিত কুমার রায় (৩৭)। বাড়ি ছাড়া হয়েছেন সুবল চন্দ্র মোহন্ত (৩২) নামের দিনমজুর।
তাদের বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ধরলা নদীর নিকটবর্তী বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবাঁশ শল্লীধরা গ্রামে। এই গ্রামের বাসিন্দা এই ৫ অসহায়-দিনমজুর। সামান্য বসতভিটার জমি ছাড়া তাদের নেই কোন নিজস্ব স্বয়সম্বল নেই। দিনমজুরী করে প্রতিদিনের আয়ের উপর নির্ভরশীল তারা।
গত ২ জুলাই শুক্রবার সকালে ফুলবাড়ী থানা পুলিশের সহযোগিতায় গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার পুলিশের একটি টিম অসহায় চার দিনমজুরকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তাদের অপরাধ প্রতারনার মাধ্যমে সরকারি ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা আত্মসাতের চেষ্টা।
এ অভিযোগে ১ জুলাই গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায় দুই সরকারী কর্মকর্তাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শ্রীপুর সোনালী ব্যাংকের হেডকোয়ার্টার শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল হক। এদের মধ্যে ৫ আসামী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা তারা সবাই দিনমুজুর। পাঁচ দিনমজুরের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়েছে পুলিশ।
ওই মামলার ৫ দিনমজুরসহ আসামী করা হয়েছে প্রতারক চক্রের সদস্য শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ, হিসারক্ষন অফিসের অডিটর আরিফুর রহমান, মাস্টাররোল কর্মচারী তানভীর ইসলাম স্বপন ও ঢাকার উত্তরখান জামতলা এলাকার শাহেনা আক্তার।
জানা যায়, শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের মাস্টারোল কর্মচারী কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাসিন্দা তানভীর ইসলাম স্বপন (৩২) করোনায় সরকারি প্রনোদনা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখান এসব দিনমজুরকে।
১৬ জুন ৫ দিনমজুরকে নিয়ে যান সোনালী ব্যাংকের নাগেশ্বরী শাখায় নিয়ে গিয়ে তাদের নামে ব্যাংক হিসাব চালু করেন। এর পর ৫ দিনমজুরদের শ্রীপুরে নিয়ে গিয়ে ব্যাংকের চেক বই ও বিভিন্ন কাগজপত্রে সহি ও টিপসহি নেন। তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেন ব্যাংকের সব কাগজপত্র ও চেক বই। ব্যাংক একাউন্টে প্রনোদনার টাকা পাঠানো হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। প্রনোদনার টাকা পাওয়ার প্রত্যাশায় দিনমজুরেরা প্রতারক চক্রের সদস্য স্বপনের সবকথা বিশ্বাস করেছেন।
সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী শাখার ব্যবস্থাপক শরিফুল আজম বিটিসি নিউজকে জানান, ব্যাংক হিসাব চালুর কিছুদিন পর এসব ৫ দিনমজুরের হিসাব নাম্বারে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা চলে আসে। এসব টাকা আসে সোনালী ব্যাংক হেডকোয়ার্টার শাখা থেকে। কয়েকদিন পর অপরিচিত ৩-৪ জন লোক এসব হিসাব নাম্বার থেকে টাকা তুলতে আসলে তার সন্দেহ হয় এবং শ্রীপুর হেডকোয়ার্টার শাখায় যোগাযোগ করে টাকা উত্তোলন বন্ধ করা হয় কিন্তু অপরিচিত লোকগুলোকে আটক করার আগেই তারা ব্যাংক থেকে সটকে পড়েন। শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ভুয়া অ্যাডভাইসের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের এই টাকা এসব হিসাব নম্বরে জমা করা হয়। হিসাব নম্বরধারী দিনমজুরেরা এসবের কোনকিছুই জানতেন না বলে তিনি জানান।
প্রভাসের স্ত্রী অঞ্জলী রানী (৪২) অশ্রু ভেঁজা কন্ঠে বিটিসি নিউজকে বলেন, তার স্বামীসহ নির্দোষ দিনমজুরদের মুক্তি চান। যারা তাদের ফাসিয়েছেন তিনি তাদের দৃষ্টান্তমুলক শান্তির দাবি করেন।
রনজিতের স্ত্রী ভারতী রানী (৩০) কান্নাজড়িত কন্ঠে বিটিসি নিউজকে বলেন, তার দিনমজুর স্বামী জেলে। তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের খাবার কেনার টাকাও নেই। কিভাবে তিনি স্বামীকে বিপদ মুক্ত করবেন। ‘আমার স্বামীসহ ৫জনেই নির্দোষ।
স্থানীয় বাসিন্দা ময়েজ উদ্দিন (৭৫) রহিমা বেগম (৫৫) বিটিসি নিউজকে জানান,পুলিশ যাদেরকে ধরে নিয়ে গেছে তারা সবাই গরীব-অসহায় পরিবার। একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না। এদের অনুদানের লোভ দেখিয়ে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে খাওয়া দাওয়ায় ঠিতমত করছে না। সব সময় কান্নাকাটি করছে।
নওদাবস শল্লীধরা ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মহেন্দ্রনাথ মন্ডল বিটিসি নিউজকে বলেন, এসব ৫ অসহায় দিনমজুর একেবারেই অসচ্ছল। কোন রকমেই দিনমজুরের কাজ-কাম করেই চলতো তাদের সংসার। সকরোনায় প্রনোদনা দেওয়ার কথা বলে তাদের ফাসানো হয়েছে। আমরা তাদেরর মুক্তি দাবী জানায়। সেই সাথে দোষী ব্যক্তিদেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বাদী জানান এ ইউপি সদস্য।
ফুলবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তদন্ত সারওয়ার পারভেজ বিটিসি নিউজকে জানান, শ্রী পুর থানা আমাদের কাছে সহযোগীতা চেয়েছে এবং আসামী আমাদের ফুলবাড়ী উপজেলায় হওয়ায় চার দিনমজুরকে গ্রেফতারের সহযোগীতা করা হয়েছে।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তদন্ত মাহফুজ ইনতিয়াজ গতকাল শুক্রবার দুপুরে মোবাইল ফোনে বিটিসি নিউজকে জানান, ১লা জুলাই শ্রীপ্রর থানায় একটি প্রতারনার মামলা হয়েছে। ২ জুলাই ফুলবাড়ী উপজেলা থেকে চার আসামীকে গ্রেফতার করে গাজীপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকী আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সেই সাথে এই মামলাটি ব্যাপক ভাবে সুষ্ঠ তদন্তের কাজও চলছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি মো. হাফিজুর রহমান হৃদয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.