পুকুরের পানি সেচ কাজে ব্যবহার দেখিয়ে নাটোরে দুই শতাধিক খাস পুকুর দখল!


নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরের সিংড়া উপজেলার ইটালী ইউনিয়নের শালমারা গ্রাম। প্রায় সাড়ে আট একরের এক সরকারী খাস দিঘি ঘিরে গ্রামটির বিস্তার। গ্রামবাসী দৈনন্দিন কাজে দিঘির পানি ব্যবহার করতেন। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসন এ দিঘি মাছচাষের জন্য ‘প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বরাদ্দ দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু পাঁচ বছর আগে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ নেতা মখলেছুর রহমান দিঘির পানি সেচ কাজে ব্যবহার হচ্ছে দেখিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। সরকারের ইজারা দেওয়া বন্ধ হয়।
আদালত স্থিতাবস্থা জারি করলে নেতা স্থানীয় ঈদগা কমিটির কাছে তিন বছরের জন্য ৮ লাখ টাকায় দিঘিটি লীজ দেন। বর্তমানে দিঘিতে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় খামারি রুবেল হোসেন।
এদিকে গ্রামবাসীর আমও গেল, ছালাও গেল। গ্রামের দরিদ্র জেলেরা মাছচাষ করতে দিঘিটি পেল না, পুকুরে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজও বন্ধ হলো। অন্যদিকে সরকারের খোয়া গেল রাজস্ব। মধ্যখান থেকে লাভবান হলেন একজন ইউপি সদস্য ও সরকারদলীয় নেতা এবং একজন মাছের খামারি।
একইরকম দৃশ্য দেখা গেল উপজেলার রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়নের শোড়াইর গ্রামে গিয়ে। শোড়াইর দিঘিটিও বিশাল। ২৭ বিঘার সরকারী এই খাস পুকুরটিতে বর্তমানে মাছ চাষ করছেন পাঁচপাকিয়া গ্রামের মৎস্যজীবী আমজাদ হোসেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য তপন কুমারের কাছ থেকে মোট ২১ লাখ টাকায় লীজ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে মাছ চাষ করছেন তিনি। তপন কুমার স্থানীয় আফতাব হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দাকে দিয়ে মামলা করে সরকারি ইজারা ঠেকিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে লিজ নিয়ে মাছের খামারি ঠেকিয়েছেন পুকুরে গ্রামবাসীর অধিকার।
মামলা করে সরকারি বন্দোবস্তে স্থিতাবস্থা আনা হয়েছে কেবল এই দুটি দিঘিতে নয়। এই প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে জেলা প্রশাসন জেলাজুড়ে এমন ১৬১টি পুকুর-দিঘির তালিকা দিয়েছে। আর গত তিন মাস ধরে জেলার সিংড়া, বড়াইগ্রাম ও লালপুর উপজেলার ১০টি গ্রামে সরেজমিনে ঘুরে গ্রামবাসী সাধারণ মানুষ আর ইউপি সদস্যদেও সঙ্গে কথা বলে আরও ৪০টি খাসপুকুর বা দিঘি এভাবে দখলের চিত্র পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ মামলার বিবরণে বাদীপক্ষ সেচকাজে পানি ব্যবহারের যুক্তি দেখিয়েছেন।
এই প্রতিবেদক চলতি বছরের গত ২৩ মার্চ তথ্য অধিকার আইনে সরকারী খাস জলাশয়ের তথ্য চেয়ে আবেদন করেন। নাটোর জেলা প্রশাসক কার্যালয় ২৯ মার্চ চাহিদা মতো তথ্য দেয়। সে তথ্য অনুযায়ী, নাটোর জেলায় মোট ৮০২টি সরকারী খাস পুকুর রয়েছে। এরমধ্যে বৈধ লীজ রয়েছে ৩৭৭টিতে। আর মোট মামলা বা স্থিতিবস্থা জারি রয়েছে ১৬১টি পুকুরে। তার মধ্যে শুধুমাত্র সিংড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে রয়েছে ১২৬টি।
তবে তিন উপজেলার ১০ গ্রাম ঘুরে স্থিতাবস্থার সুযোগে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা আরও ৪০টি পুকুরের তথ্য পাওয়া গেছে। জেলাজুড়ে সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে।
বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে সরেজমিনে সিংড়ার ইটালী, চৌগ্রাম, রামানন্দ খাজুরা, ছাতারদিঘি, ডাহিয়া, বড়াইগ্রাম উপজেলার শিবপুর, লালপুর উপজেলার ঈশ্বরপাড়া গ্রামে স্থিতাবস্থা জারি থাকা অন্তত ২০টি দিঘি-পুকুর ঘুরে দেখেছেন, যেগুলো জেলা প্রশাসনের দেওয়া তালিকায় নেই। প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী সিংড়ার ইটালী ইউনিয়নে খাসপুকুর আছে ৯২টি। সেগুলোর মধ্যে ২২টি পুকুরের ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে ইজারা না দিতে স্থিতিবস্থা জারি করা হয়েছে। তথ্য বলছে, শালমারা গ্রামের দিঘিটি সরকার শেষ ইজারা দিয়েছিল ১৪২১-২৩ বাংলা সালে, ১লাখ ১৫ হাজার ৭৬৩ টাকায়।
তারপর ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মখলেছুর রহমান মামলা করেন। ফলে গত পাঁচ বছর সরকার এটি লিজ দিতে পারেনি। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে এই একটি পুকুর থেকেই সরকার কম করে ৭ লাখ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।
মামলার বাদী মখলেছুর রহমান বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, তিনি গ্রামবাসীর পক্ষে মামলাটি করেছেন। আদালত সরকারিভাবে পুকুরটি লীজ না দিতে স্থিতিবস্থা জারি করেন। পরে গ্রামবাসীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ৮ লাখ টাকায় স্থানীয়ভাবে লীজ দিয়ে তা উন্নয়ন খাতে ব্যয় করছেন। জনস্বার্থেও যুক্তিতে ইজারায় স্থিতাবস্থা থাকাকালে পুকুর লীজ দেওয়া যায় কি না, সে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, পুকুরের টাকা কারও পকেটে যায় না। গ্রামের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যায় করা হয়।পুকুরটি লীজ নিয়েছেন রুবেল হোসেন। তিনি বললেন, স্থানীয় ঈদগা মাঠের সংষ্কার করার জন্য গ্রামবাসীর সিদ্ধান্তে তাদের পক্ষে মখলেছুর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন। আদালত সরকারি লিজে স্থিতিবস্থা জারি করলে রুবেল গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরটি লীজ নিয়েছেন। লীজের সে টাকা ঈদগা মাঠের উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করা হয়।
ছয়বছর হলো একই ইউনিয়নের বনকুড়ি মৌজায় দুটি পুকুর মোট দুই লাখ ৫০ হাজার টাকায় তিনবছর মেয়াদি লিজ দিচ্ছে বুনকুড়ি মোহাম্মদিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, কমিটি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে পুকুরটি ভোগদখল করছে। লিজের টাকা মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যায় করা হচ্ছে।
আদালতের স্থিতাবস্থা ভেঙে এভাবে লিজ দেওয়াকে সম্পূর্ণ অবৈধ বললেন, ইটালি ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাইজুল ইসলাম। তাঁর ইউনিয়নে মোট ৯২টি পুকুরের ২২টিতে এভাবে মাছ চাষ চলছে। প্রভাবশালীরা আইন ভেঙে স্থিতাবস্থার পুকুর অন্যের কাছে লীজ দিয়ে টাকা কামাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বাধা প্রদান করলে হয়রানির হুমকি দেওয়া হয়।
প্রশাসনের দেওয়া তথ্য বলছে, লালপুরের ঈশ্বরপাড়া দিঘি-১ শেষ ইজারা হয়েছিল বাংলা ১৪২৬ সালে সাড়ে আট লাখ টাকায়। ঈশ্বরপাড়া দিঘি-২ শেষ ইজারা হয়েছিল ১৪২২ সালে, ৭৮হাজার ৭৫০ টাকায়। বড়াইগ্রামের শিবপুর পুকুরটি ১৪২৬ সাল থেকে ইজারার বাইরে। ৯ হাজার টাকায় শেষ ইজারা হয়েছিল। নলডাঙ্গা, গুরুদাসপুর এবং লালপুর উপজেলায় ১৩টি পুকুর অবশ্য কখনোই সরকার ইজারা দেয়নি, তারপরও মামলা হয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.