পাবনা টিটিসি’র অধ্যক্ষ-হিসাবরক্ষকের অনৈতিক সম্পর্ক ও দুর্নীতি-অনিয়মে ভেঙ্গে পড়েছে টিটিসির স্বাভাবিক কার্যক্রম

পাবনা প্রতিনিধি: পাবনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি)‘র অধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার অনৈতিক সর্ম্পক ও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে টিটিসির স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায় অধ্যক্ষ মো. সাইদুল ইসলাম ২০২০ সালে পাবনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদানের পর থেকেই উক্ত প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
অধ্যক্ষ হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়ম করে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করছেন। তার বিরুদ্ধে এর আগেও স্থানীয়, জাতীয় পত্রিকায় দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এই যুগল আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
উল্লেখ্য, ইতি পূর্বেও দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় শাস্তি হিসাবে অধ্যক্ষের দুইটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন করা হয়েছে। অধ্যক্ষের পূর্ব কর্মস্থলেও খোঁজ নিয়ে তার ব্যপক দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।
অধ্যক্ষ সাইদুল ইসলামের স্ত্রী-পরিবার আমেরিকা প্রবাসী এবং হিসাবরক্ষকের স্বামী পাবনা না থাকায় তারা অবাধে মেলামেশা করেন। অধ্যক্ষ এবং হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার অবাধ মেলামেশায় টিটিসির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিব্রত। এই যুগলের কর্মকান্ডে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউই কিছু বলারও সাহস পান না।
সরকারি বিধি মোতাবেক অধ্যক্ষের কোয়ার্টারে থাকার কথা থাকলেও সে নিয়ম ভঙ্গ করে কোয়ার্টার ভাড়া দিয়ে একাডেমীক ভবনের তৃতীয় তলায় হোটেল হাউজ কিপিং এর ভিআইপি রুমে থাকেন। হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অফিসকালীন সময়ের বেশির ভাগ সময় উক্ত রুমে অধ্যক্ষের সাথে অবস্থান করেন।
অধ্যক্ষ পাবনা টিটিসি’র হিসাবরক্ষক এর মাধ্যমে ভুয়া ভাউচারে সরকারি ও বিভিন্ন প্রজেক্টের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে পাবনা টিটিসির হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অধ্যক্ষের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে পরোক্ষভাবে তিনিই টিটিসি পরিচালনা করছেন। যে কারণে টিটিসির স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পরেছে।
হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অধ্যক্ষের রুমে অবস্থান করেন এবং টিটিসির সবাইকে তিনিই মূলত নির্দেশনা প্রদান করে থাকেন। একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি তার উপরের গ্রেডে চাকুরিরত শিক্ষকদেরকেও স্যার বলে সম্বোধন করেন না বরং অনেক শিক্ষককে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাকে ম্যাডাম বলে ডাকতে হয়। একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর কাছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি জিম্মি হয়ে আছে। অধ্যক্ষ-হিসাবরক্ষক যুগলের ভয়ে টিটিসি’র শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।
গত কয়েক দিন আগে অধ্যক্ষ ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালামার একটি ভিডিওচিত্র ফাঁস হয়। ভিডিওচিত্রে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমাকে অধ্যক্ষের কাধে হাত দিয়ে শরীর ঘেষে বসে কথা বলতে দেখা যায়।
আরেকটি ভিডিওচিত্রে অবাধে ঘুষ নেওয়ার একাধিক ভিডিওচিত্র প্রকাশ পায়। উক্ত ভিডিওচিত্রগুলো প্রতিবেদকের হাতে আসায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে সেখানে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষক, কর্মকতা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধ্যক্ষ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহা-পরিচালক মো. শহিদুল ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে সমস্ত অপকর্ম করে যাচ্ছেন। অধ্যক্ষ নিজে টাকা গ্রহণ না করে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার মাধ্যমে সমস্ত অবৈধ লেনদেন করে থাকেন ।
টিটিসি’র দুজন শিক্ষক বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে ভিডিওচিত্রের ঘটনার ব্যাপারে সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা পূর্ব পরিচিত। তাদের দেয়া তথ্যনুয়ায়ী এই বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিবেদক জানতে পারেন, হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা ও তার পরিবার কাউকে পরোয়া করেন না। তার বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৩য় স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগসহ তার পরিবারের বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যায়।
শিক্ষকেরা হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার আরও অনেক তথ্য প্রদান করেন। উম্মে সালমা সম্প্রতি ১৬ লক্ষ টাকা দিয়ে প্রাইভেট কার কিনেছেন, তার বাসায় একদিনে ১০ লক্ষ টাকার আসবাবপত্র ক্রয় করেছেন।
এছাড়াও তার বাসায় সব রুমে এসি সেট করেছেন। তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিবরামপুর শাখায় তার পূর্বের ব্যাংক লোন প্রায় পাচ লক্ষ টাকা এককালীন পরিশোধ করেছেন। হিসাবরক্ষক এর বাড়ী টিটিসি থেকে ২৬ কিলোমিটার (ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে) দূরে হওয়ায় তিনি প্রতিদিন তার নিজস্ব প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন। তার এরূপ আঙ্গুল ফলে কলাগাছ হওয়ায় টিটিসিতে অধ্যক্ষ সাইদুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার দুর্নীতির ভয়াবহতা প্রকাশ পায়।
এব্যাপারে আরেকজন শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, “ভাই দয়া করে আর কিছু লিখেন না। কারা সাংবাদিককে তথ্য দিয়েছে, কারা ভিডিও করেছে এই সন্দেহে প্রিন্সিপাল স্যার টিচার ও স্ট্যাফদের সাথে দুর্ব্যবহার ও হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। ভাই আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দেন।”
একজন শিক্ষক দুঃখ প্রকাশ করে বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, ১০ম গ্রেডে চাকুরী করেও শিক্ষকেরা যখন সংসার চালাতে হিমশিম খান, সেখানে ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, হিসাবরক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতায় অনেকে ক্ষুব্ধ ও বিব্রতবোধ করলেও বদলির ভয়ে অনেকে মুখ বুঝে সহ্য করলেও কিছু বলার সাহস পান না। তিনি একজন মহিলা হওয়ায় খুব সহজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ম্যানেজ ও কজ্বা করে ফেলেন।
শিক্ষকেরা আরও জানান, “অনৈতিক সম্পর্কের কারণে অধ্যক্ষ স্যারকে ব্ল্যাক মেইল করে হিসাবরক্ষক উম্মে সালমা অনেক কাজ করতে বাধ্য করেন।” আর এই ভিডিওচিত্র প্রকাশের পর থেকে অধ্যক্ষ স্যারও বিব্রতবোধ করছে।
এছাড়াও ঘুষের ভিডিওতে বিদেশগামী কর্মীদের একে একে টাকা দিয়ে সার্টিঢিকেট নিতে দেখা যায়। উল্লেখ্য পাবনা টিটিসিতে বিদেশ গমনিচ্ছুক কর্মীদের বাধ্যতামূলক ৩ দিনের প্রি-ডিপারচার ট্রেনিং প্রদান করা হয়। এখানেও উম্মে সালমা ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ঘুষ ও সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। তিন (৩) দিনের ট্রেনিং এ সরকারি ফি দুইশত (২০০) টাকা হলেও সার্টিফিকেট প্রতি অধ্যক্ষের স্বাক্ষরের জন্য অতিরিক্ত দুইশত (২০০) টাকা করে রাখা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মী বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, এখানে ভিসা চেকের জন্য অতিরিক্ত একশত (১০০) টাকা এবং সার্টিফিকেট নিতে ২০০ টাকা করে দিতে হয় আর টাকা না দিলে সার্টিফিকেট আটকে রাখা হয়। আর যারা ট্রেনিং করে না তাদের কাছে সুযোগ বুঝে এক হাজার (১০০০) থেকে তিন হাজার (৩০০০) টাকায় সার্টিফিকেট বিক্রি করা হয়।’
অধ্যক্ষের বক্তব্য নেওয়ার জন্য পাবনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেলে প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে অধ্যক্ষ নিজেই বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে বলেন, “অধ্যক্ষ জরুরী কাজে শহরে গিয়েছেন”। অপেক্ষারত থাকাকালীন সময়ে অধ্যক্ষ দুজন শিক্ষককে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান এবং প্রতিবেদকের অনারিয়াম (সম্মানি) কত জানতে চান। প্রতিবেদক সম্মানির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে চলে আসেন।
এসময় হিসাবরক্ষক উম্মে সালমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে জানার জন্য উম্মে সালমাকে ফোন করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন।
পাবনার সচেতন মহল মনে করেন, দু-একজন ব্যাক্তির এমন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পাবনা টিটিসি’র সুনাম নষ্ট হোক কিংবা ক্ষতি হোক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনে বঞ্চিত হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। সচেতন মহল এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর পাবনা প্রতিনিধি আর কে আকাশ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.