পাবনার প্রবীণ শিক্ষকের এখন রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করে চলে সংসার!

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রতিদিন ভোর সকালে ভাঙাচোরা একটি বাই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পড়াতে, ফিরতেন রাতে। অনেকেই তার কাছে প্রাইভেট পড়ে উচ্চ জায়গায় পৌঁছেছেন।  মাস শেষে অনেক শিক্ষার্থী টাকা দিয়েছে আবার কেউবা দিতে পারেনি। কোনদিনও তিনি সে টাকা চাননি। কিন্তু আজ তিনি ভাগ্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। এক সময় হাতে খাতা ও পকেটে কলম থাকলেও বর্তমানে রাজমিস্ত্রীর জোগালীর কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষক গয়ানাথ সরকার।
‎পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের কুমারগাড়া গ্রামের এই প্রবীণ শিক্ষক।তিনি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরনপোষণ এবং লেখাপড়া টাকা যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
‎বড় ছেলে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে, দ্বিতীয় ছেলে দশম শ্রেণিতে এবং মেয়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। প্রাইভেট পড়িয়ে এবং ওই কেজি স্কুলে চাকরি করে যে টাকা আয় করতেন তাতে করে ভালোই চলত তার। কিন্তু বেতন না বাড়ায় স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন গয়ানাথ সরকার। এরপর প্রাইভেট পড়ানোয় সীমাবদ্ধ থাকেন।
‎দারিদ্রোর কারণে নিজের পড়ালেখা হয়নি বলে তিন সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করার ইচ্ছে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছেন তিনি।
‎খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক (এসএসসি) পাশ করেন গয়ানাথ সরকার। কিন্তু পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। শুরু করেন প্রাইভেট পড়ানো। পাশাপাশি দিনমজুরির কাজ করেও তিনি জীবনযাপন করতেন। ইংরেজি ও অঙ্কে পারদর্শী ছিলেন। পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করেন।
‎দিন-রাত ব্যাচ আকারে প্রাইভেট পড়াতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গয়ানাথের শিক্ষকতার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশ এলাকায়। বাড়ি বাড়ি পড়ানো শুরু করেন। এরপর পৌর শহরে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি পান। অল্প বেতন হলেও শুধু সম্মানের জন্য এই পেশাকে আঁকড়ে ধরেন।
‎চাটমোহর পৌর এলাকার বিভিন্ন স্কুলের যেসব ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতেন তিনি, সেসব স্কুল থেকে অভিভাবকদের বলা হয়েছিল, ‘স্কুলের শিক্ষকদের কাছে না পড়ালে নম্বর কম পেলে এ জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় বলে হুমকি দেওয়া হয়।’ এরপর থেকেই  গয়ানাথের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। একটা সময় পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন প্রবীণ এই শিক্ষক। দিশেহারা হয়ে পড়েন সংসার চালাতে। বেঁচে নেন এমন কষ্টের পথ।
‎এক দিকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে তিন সন্তানকে পড়াশোনার টাকা যোগাড় করতে হচ্ছে। তার কাছে পড়ে অনেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ও বড় বড় উচ্চ স্থানে পৌঁছালেও আজকে তিনি রাজমিস্ত্রীর জোগালির কাজ করছেন। দিনে ৩০০/৪০০ টাকা করে মজুরী পেয়ে থাকেন। এটা দিয়েই কোনমতে সংসারের চাকা ঘুড়িয়ে থাকেন।
‎এলাকাবাসীর কয়েকজন বিটিসি নিউজকে বলেন, অনেক বছর ধরে আমরা দেখতেছি তিনি কঠোর পরিশ্রম করে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। নিজের বাড়িতেও ব্যাচ করে পড়াতেন। অল্পদিনেই ব্যাপক সুনাম অর্জন করে ছিলেন। আমরা দেখেছি সে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। কারও সঙ্গে কোনদিন অসদাচরণ করেননি। সাধারণভাবে জীবনযাপন করছেন। সবার সঙ্গে মিষ্টি ভাষায় কথা বলতেন। এখন দেখতেছি তিনি রাজমিস্ত্রীর জোগালির কাজ করছেন। এটা খুবই দু:খজনক। তার একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
‎তারা আরও বলেন, বর্তমান সময়ে অনেকে অসদুপায়ে উপার্জন করে থাকেন। সমাজে অনেকে মাদক ব্যবসা ও সুদের ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন। কিন্তু তিনি শিক্ষক হয়েও ওসব অসৎ পথ বেঁচে নেননি। তাদের মত মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রে দরকার আছে।
‎ইব্রাহিম হোসেন মোল্লা নামের এক অভিভাবক বিটিসি নিউজকে বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলা অংকে বেশ দুর্বল ছিল। অনেক দূর থেকে আমার ছেলেকে গয়ানাথ স্যারের কাছে নিয়ে আসতাম। এই লোকটি শত-শত শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। ব্যাপা আলো ছড়িয়েছেন। কিন্তু তিনি আজকে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে জীবনযাপন করছেন। এটি খুবই দু:খজনক ব্যাপার। তার একটি কর্মসংস্থান হওয়া জরুরী।
‎শিক্ষক গয়ানাথ সরকার বিটিসি নিউজকে বলেন, অসংখ্য ছাত্রকে প্রাইভেট পড়িয়েছি। অনেকের ভালো কর্মসংস্থান হয়েছে। অনেক টাকা বেতন পেয়ে তারা খুবই সুখে আছে। এটা আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা পেশায় থাকলেও এখন আমি রাজমিস্ত্রীর কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে আমাকেও রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে হবে। এটি করতে লজ্জা লাগলেও সংসার পরিচালনা করার জন্য আমাকে করতেই হবে।
‎চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসা নাসের চৌধুরী বিটিসি নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। আমি তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেবো। তার সাথে কথা বলে তার প্রত্যাশা কি জেনে আমরা উপজেলা প্রশাসন তার পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায় সেই চেষ্টা করবো।’
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নিজস্ব প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম / পাবনা। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.