পানির দাবিতে মাহালী আদিবাসীদের কলস নিয়ে মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান

প্রেস বিজ্ঞপ্তি: জিউই বান্চাও লাগিতে দ্যা হাতোই আলে অর্থ্যাৎ জীবন বাঁচাতে পানি চাই। আদিবাসী মাহালী বাঁশ বেত উন্নয়ন সংগঠনের সভানেত্রী চিচিলিয়া হেমব্রোম তার নিজ মাহালী ভাষার মাধ্যমে পানির অধিকার দাবি করেন।
আজ বুধবার (১৫ মার্চ ২০২৩) রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে সকাল ১০ ঘটিকায় রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা পৌরসভার আদিবাসী মাহালী পাড়াসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের পানির অধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
আদিবাসী মাহালী বাঁশ বেত উন্নয়ন সংগঠন, বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরাম ও বারসিক’র যৌথ আয়োজনে এতে অংশগ্রহণ করেন মাহালী আদিবাসী নারী পুরুষ, রাজশাহীর আদিবাসী নেতা নেত্রীসহ নাগরিক যুব সমাজের প্রায় শতাধিক প্রতিনিধি। মানববন্ধন শেষে তাঁরা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান।
মাহালী আদিবাসী নেত্রী চিচিলিয়া হেমব্রোমে সভাপতিত্বে ও বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরামের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আতিকুর রহমানের সঞ্চালনায় পানির অধিকার ও নিরবিচ্ছিন্ন পানির জন্য উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য দেন মাহালী আদিবাসী বাঁশ বেত উন্নয়ন সংগঠনের সদস্য ও নেত্রী রিনা টুডু, মনিকা টুডু, জেসতিনা টুডু, বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরামের সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল, রাজশাহী সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদ জামাত খান, আদিবাসী নেতা সুভাস চন্দ্র হেমব্রম, বারসিকের গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়ক শহিদুল ইসলাম, ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস) এর সভাপতি শামীউল আলীম শাওনসহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
অংশগ্রহণকারি চিচিলিয়া হেমব্রম বলেন- “ দীর্ঘ দিন থেকে আামাদের মাহালী পাড়াতে কোন পানি নেই, খাবার পানির জন্য কখনো আধা কিলো মিটার, এক কিলোমিটার যেতে হয়। তাতেও পানি পাওয়া যায়না। মানুষের পানির উৎস থেকে পানি আনতে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীদের। অনেক সময় পানি আনতে নারীদের কোমরে ব্যাথাসহ নানা ধরনের দুর্ঘটানার শিকার হতে হয়। অনেক দুরে গিয়ে পানি কিনে আনতে হয়। অভাবের সংসারে পানি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা দিন মজুরী বা বাঁশ বেতের কাজ করে প্রায় তিনশত টাকা ইনকাম করি, এর মধ্যে পানি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ”
একই পাড়ার মাহালী আদিবাসী নেত্রী রিনা টুডু বলেন-“ শতবার ধরণা দিয়েছি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে, কেউ পানির সমাধান করে দিলো না আজো। প্রায় তিনশো মানুষ আমরা মানবেতর জীবন যাপন করছি। তাই পানির অধিকারের জন্য আমরা আজ সেই তানোর থেকে কষ্ট করে রাজশাহী শহরে এসে জীবন বাঁচানোর দাবি জানাচ্ছি।” মানববন্ধনে মাহালী নারীগণ কলস নিয়ে পানির জন্য দাবি জানান। নাগরিক সমাজের জামাত খান অবিলম্বে আদিবাসী মাহালী সম্প্রাদায়ের পানির সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে আহবান জানান।
বারসিক’র গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বলেন- বৈশ্বিক জলবায়ুর আঞ্চলিক অভিঘাতসহ পানি সমস্যা বরেন্দ্র অঞ্চলে নীরবে মারাত্বক হয়ে উঠছে। একসময় গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক মানুষগুলো প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানির ব্যবহার করতো। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক উৎসগুলো দিনে দিনে দখল আর নষ্ট হওয়াসহ প্রভাবশালীদের লিজ নেবার কারনে সেখানে প্রান্তিক মানুষ আর পানির অধিকার নিশ্চত করতে পাচ্ছেনা। অন্যদিকে উন্নয়নের ভুল পদক্ষেপের কারনে এই অঞ্চলের ভুগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্বকভাবে নীচে নেমে গেছে। যার ফলে রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পানির উৎস পাতকুয়া, কুয়া, পুকুড়, জলাশয়, টিউবয়েল, নলকুপগুলোতে আর পানি পাওয়া যায়না। এর স্থলে বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পানি সেবার নামে আর্থিক মূল্যে পানি বিক্রি করছে এখন। পানি ব্যবস্থাপনায় জনগোষ্ঠীর মতামতগুলো উপেক্ষা করা এবং ডিপ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় প্রভাবশালীদের দৌরাত্বের কারনে পানির জন্য সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামগুলোতে খাবার পানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মাফিক পানির অভাব দেখা দিয়েছে মারাত্বকভাবে। আবার বার বার ধরণা দিয়েও অনেকসময় পানির অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছেনা প্রান্তিক মানুষগুলোর। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো জনমতামত ও গবেষণা করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
আদিবাসী নেতা সুভাস হেমব্রোম বলেন- “আদিবাসীদের সব ধরনের অধিকার থেকে অনেক সময় বঞ্চিত করা হয়। সমতলের আদিবাসীরা পানির জন্য প্রতারণার শিকার হচ্ছে অহরহ। পানির জন্য আদিবাসীদের জীবন দিতে হচ্ছে। তিনি সকল আদিবাসী গ্রামে সুপেয় পানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পানির সমস্যা সমাধানে দাবি জানান। ”
বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরামের সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল বলেন- বরেন্দ্র অঞ্চলের স্থানীয় পুকুড় জলাশয়গুলো প্রভাবশালীরা লীজ নিয়ে তাতে রাসায়নিক কীটনাশক দিয়ে মাছ চাষ করে এবং সেসকল পুকুড় থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতেও বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এরকম ঘটনা বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় গ্রামগুলোতেই কম বেশি দেখা যায়। তিনি গ্রামের পুকুর/দিঘি ও জলাশয়গুলো গ্রামের মানুষকে শর্তহীন ব্যবহার করতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
মানববন্ধন শেষে অংশগ্রহণকারিগণ জেলা প্রশাসক বরাবর ৪টি দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপি প্রদান কালে দাবিগুলোর সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে সেগুলো বাস্তবায়নের আহবান জানা রাজশাহী মহানগরীর সাবেক সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান।
উপস্থাপিত দাবিগুলো হলো-
০১। তানোর উপজেলার মন্ডুমালার আদিবাসী মাহালী পাড়াতে দ্রæত পর্যাপ্ত ডিপটিউবয়েল/টিউবয়েল/ সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করে আমাদের পানির সমস্যা সমাধান করে দিতে হবে।
০২। রাজশাহী জেলা তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের পুকুড়/ দিঘি এবং চলমান জলাভ‚মি লিজ প্রথা সংশোধন করে সত্যিকারে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষের ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে হবে।
০৩। গ্রামের ভিতরে বা কাছাকাছি পুকুড়গুলো গ্রাম বাসির নামে/ কমিউনিটির নামে বিনাশর্তে লিজ দিতে হবে যাতে কমিউনিটির মানুষগুলো এটি ব্যবহার করতে পারে।
০৪। বরেন্দ্র অঞ্চলের সকল পুকুড়/দিঘিগুলো সংস্কার করে দিতে হবে। যাতে ভ‚-উপরিস্থ পানির ব্যবহার করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারসহ কৃষি কাজে ব্যবহার করা যায়।
উল্লেখ্য যে, রাজশাহীর তানোর উপজেলার মন্ডুমালা পৌরসভার আদিবাসী মাহালী পাড়াটিতে দীর্ঘযুগ থেকে প্রায় শতাধিক আদিবাসী মাহালী পরিবারে বসবাস। বাঁশ বেতের কাজ তাঁদের মূল পেশা হলেও দিনে দিনে এই পেশার নানামূখী সংকটের কারনে পেশার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত পরিবারগুলো কোনমতে জীবীকা নির্বাহ করেন। এই অবস্থায় উচ্চ মূল্যে পানি কিনে খাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রতিবেদনে সহায়তা: মো: শহিদুল ইসলাম, গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.