পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে : প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অনেকেই নানা মনগড়া মন্তব্য করছেন। তবে বর্তমানে আমাদের পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অনেকেই নানা মনগড়া মন্তব্য করছেন। তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর মত রিজার্ভ থাকলেই চলে। বর্তমানে আমাদের পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয়  মেটানোর মত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ আছে।”
“করোনাভাইরাসের মহামারির সময় সব ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশ ভ্রমণ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি অনেকটা বন্ধ ছিল। সে সময় আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অলস অবস্থায় না রেখে সেখান থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ দিয়ে আমরা একটা বিশেষ তহবিল গঠন করেছি। সেই তহবিলের অর্থ দ্বারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।”
“সোনালি ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ দেওয়া হচ্ছে ২ শতাংশ হার সুদে। ঘরের টাকা সুদসহ ঘরেই ফেরত আসছে। এ অর্থ যদি বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হতো তাহলে ৪/৫ শতাংশ হারে সুদসহ ফেরত দিতে হতো। আর তা পরিশোধ করতে হতো রিজার্ভ থেকেই। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমরা বেশি দামে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, গম, ডাল, ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য ক্রয় করে স্বল্পমূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করছি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। অযথা গুজবে কান দিবেন না। বাংকে টাকার কোন ঘাটতি নেই। উপার্জিত টাকা ঘরে রেখে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। আমাদের বিনিয়োগ, রেমিটেন্স প্রবাহ এবং আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে।”
বলেন, “আমাদের বিগত ১৪ বছরে দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হতে পেরেছে। দেশ আজ খাদ্যশস্য-উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চলতি বছর ৪ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন চালসহ ৪ কোটি ৭২ লাখ মেট্রিক টন দানাদার শস্য উৎপাদিত হয়েছে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবজি, ফলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গোটা বিশ্ব আজ এক অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনাভাইরাস মহামারির কবলে পড়ে বিশ্ব। ২০২০ এবং ২০২১ এই দুই বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অনেক দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। আমাদের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়ে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির সেই ক্ষতি কাটিয়ে যখন আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক যুদ্ধ। অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রভাব কোন একক দেশের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক অবরোধ-পাল্টা অবরোধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।”
তিনি বলেন, “আপনারা জানেন, সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমরা করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের প্রাণহানি যেমন কমাতে পেরেছি, তেমনি অর্থনীতিকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি তাঁদের জীবিকা সচল রাখা। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে আমরা জরুরিভিত্তিতে বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫ হাজার শয্যা বৃদ্ধি করেছিলাম। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা জন্য পিপিই, রোগীর জন্য অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, জরুরি ওষুধসহ সকল উপকরণ সরবরাহ করা হয়।”
“টিকা পাওয়ার উপযোগী সবাইকে বিনামূল্যে প্রায় ৩৪ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ প্রথম ডোজ, ১২ কোটি ৬৫ লাখ ২৫ হাজার দ্বিতীয় ডোজ এবং ৬ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ বুস্টার ডোজ পেয়েছেন।” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “শিল্পকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তার জন্য এখন পর্যন্ত আমরা ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতনভাতা নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫০ লাখ প্রান্তিক মানুষকে দুই দফায় আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন যানবাহনের শ্রমিক, দোকান কর্মচারি, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক, ইমাম, মুয়াজ্জিন, সংস্কৃতি কর্মীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।”
“বস্তিবাসী, দরিদ্র ও স্বল্পআয়ের মানুষ যারা অন্যের কাছে হাত পাততে পারেন না, হটলাইনে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘরে চাল-ডালসহ খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় প্রায় ৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮১ হাজার ২৬৬টি।” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরও বলেন, “ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং পাল্টা অবরোধের কারণে আমাদের মত উন্নয়নশীল ও আমদানি-নির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, গম, চিনি, ভুট্টা, ডাল, রাসায়নিক সারসহ প্রায় সকল ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।”
বলেন, ” সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পরিবহন খরচ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে জাহাজ ভাড়া ছিল ৮০০ ডলার তার ভাড়া এখন ৩ হাজার ৮০০ ডলার; যে গম টন প্রতি ২০০ ডলারে পাওয়া যেতো, তা ৬০০ ডলারে কিনতে হচ্ছে। আবার নিজস্ব চাহিদা মেটানোর জন্য কোন কোন দেশ বিনা নোটিশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা পৃথিবীর যেখানেই আমাদের চাহিদার পণ্য পাওয়া যাচ্ছে এবং যত দামই হোক, সেখান থেকেই তা সংগ্রহ করছি এবং যোগান দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ১ কোটি পরিবারকে টিসিবি’র ফেয়ার প্রাইজ কার্ড দিয়েছি। এই কার্ডের মাধ্যমে পরিবারগুলো ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও সাশ্রয়ীমূল্যে ভোজ্য তেল, ডাল ও চিনি সংগ্রহ করতে পারছেন। ৫০ লাখ পরিবার ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল কিনতে পারছেন। অসহায় মানুষদের ভিজিডি ও ভিজিএফ-এর মাধ্যমে ৩০ কেজি করে চাল প্রতিমাসে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।”
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ (ঢাকা) প্রতিনিধি মো: ফারুক আহম্মেদ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.