নানা দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্যদিয়ে চলছে খুমেক হাসপাতাল

 

খুলনা ব্যুরো : সরকারি হাসপাতালের গাড়ি চালাচ্ছেন ব্যক্তিগত ড্রাইভার, সরকারি চাকরীজীবীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বহিরাগতদের, বিশেষ একটি উপজেলার লোক ছাড়া চলছে না হিসাব বিভাগও। এভাবেই অনেকটা ইচ্ছামত চলছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দালাল তাড়াতে হাসপাতালের ওয়ার্ডসহ প্রতিটি স্থানে সাউন্ড বক্স বসিয়ে করা হচ্ছে শব্দ দূষণও।

সেই সাথে মটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণে হাসপাতালের জরুরি বিভাগকে এমনভাবে আটকিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে একজন মুমূর্ষ রোগীকে দ্রুত ভর্তিতেও বেগ পোহাতে হয়। এসব উন্নয়নমূলক কাজও আবার করা হচ্ছে হাসপাতালের পণ্য সামগ্রীর অর্থ দিয়ে। সেই সাথে এজন্য কোন টেন্ডার না দিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের নিজস্ব লোক দিয়ে করানো হয় এসব কাজ।

যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ গত বছর(২০১৭) যোগদান করেই ঘোষণা দিয়েছিলেন হাসপাতালের মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধ করবেন। বাণিজ্য বন্ধ হলেও এখন নানাখাতেই সার্টিফিকেট গ্রহীতাদের অর্থ খরচ করতে হয়।

আগে যেখানে বোর্ডের মাধ্যমে সার্টিফিকেট দেয়া হতো সেখানে একটি পক্ষকে ম্যানেজ করেই সার্টিফিকেট গ্রহণ করা হতো। কিন্তু এখন থানা বা আদালতের চাহিদা মোতাবেক সার্টিফিকেট দেয়ার নিয়ম করায় সার্টিফিকেট গ্রহীতাকে প্রথমে রোগী ভর্তির সময় জরুরি বিভাগের ডাক্তারকে ম্যানেজ করে যেমন রোগীর বৃত্তান্ত লেখাতে অর্থ খরচ করতে হয় তেমনি থানা পুলিশকেও রিকুইজিশন দেয়ার জন্য দিতে হয় অর্থ।

আবার হাসপাতালের যে কর্মচারীর কাছে পত্রটি আসে এবং যার মাধ্যমে সার্টিফিকেটটি চূড়ান্তভাবে ইস্যু হয় তাকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ না করলে যথাসময়ে সার্টিফিকেট পাঠানো হয়না না থানা বা আদালতে। হাসপাতালের অপর একটি সূত্র জানায়, বর্তমান তত্ত্বাবধায়কের নিজ উপজেলা ফুলতলার একজন গাড়ি চালককে দিয়েই সরকারি গাড়ি চালানো হচ্ছে। যদিও হাসপাতালের নিয়োগকৃত তিনজন চালক রয়েছেন।

একটি সরকারি গাড়ি কিভাবে ব্যক্তিগত চালক দিয়ে পরিচালনা করা হয় সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরোজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, সম্প্রতি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহি:বিভাগ ও আন্ত:বিভাগে ৩৫টি সাউন্ড বক্স লাগানো হয়েছে। যে বক্সে মাঝে মধ্যে ঘোষণা দেয়া হয় দালাল থেকে সাবধানতা অবলম্বনের। তাছাড়া হাসপাতালের ভেতরে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় তারও ঘোষণা দেয়া হয় ওই মাইকে।

যখন বক্সগুলো উচ্চ আওয়াজ দিয়ে বাজানো হয় তখন রোগীদের পাশাপাশি ভিজিটরদেরও বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। সেই সাথে জরুরি বিভাগ থেকে যাতে হাসপাতালের ভেতরে মটর সাইকেল প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সম্প্রতি কিছু পাইপ বসানো হয়েছে। এর ফলে রোগী ওঠানামায়ও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়কের নিজ উপজেলা ফুলতলা থেকে কিছু লোক এনে হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে বসিয়ে রেখে খবরদারি করারও অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, ইসিজি বিভাগে অরিনা, আল্ট্রাসনো বিভাগে তমা, কেবিন ব্লকে রুবি, রান্নাঘরে সোলায়মান, বহি:বিভাগের অর্থোপেডিক বিভাগে সাদিয়া এবং মাইকিংয়ের কাজে নিয়োজিত খোকন কেউই হাসপাতালের কর্মচারী নন।

ফ্রি সার্ভিস হিসেবে যারা কর্মরত তাদেরকে পরিচয়পত্র দিয়েও আলোচনায় এসেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক। যেসব লোক হাসপাতালের বেতনভুক্তই নয় তাদেরকে পরিচয়পত্র দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়কে বৈধতা দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগও অনেকের।
তবে সব ব্যাপারেই জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ।

এদিকে, সম্প্রতি হাসপাতালের ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য টেন্ডার আহবান করায় একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠলেও সেটি ধামাচাপা দেয়ার চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৪২ প্রকারের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য প্রায় ৩০ কোটি টাকার এ টেন্ডারে অংশ নেয়া মেডিকো কর্পোরেশন নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিছু সনদপত্র জাল করে জমা দিয়েছেন।

পরে বিষয়টি যাচাই-বাছাইকালে ধরা পড়লেও ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরিবর্তে তাকে রক্ষার চেষ্টা চলছে। খুলনা জেনারেল হাসপাতালের প্যাথলজী বিভাগের একজন কর্মচারীর শ্বশুরের নামের ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার নামে খুমেক হাসপাতালের একজন শীর্ষ কর্তাব্যক্তি কয়েক লাখ টাকা অবৈধ আয় করেছেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।

এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়কের চক্ষুশুলে পরিণত হন হিসাব বিভাগের এক কর্মচারী। যে কারনে তাকে বদলী করে ফুলতলারই এক বাসিন্দাকে আনা হয়েছে খুলনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে। এভাবে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে চলমান গণপূর্ত বিভাগের পক্ষ থেকে উন্নয়ন কাজেরও নেই সঠিক কোন তদারকি।

যে কারনে সামান্য বৃষ্টি হলেই হাসপাতালের অফিস ব্লক তলিয়ে যায় পানিতে। এ নিয়েও হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এছাড়া হাসপাতালের জরুরি ও বহি:বিভাগে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হলেও দালাল চক্রের দৌরাত্ম বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন একই জাতীয় লোকজন হাসপাতালের বহি:বিভাগে ঘোরাঘুরি করলেও কোন প্রতিকার নেই।

শোনা যাচ্ছে প্রতিটি বিভাগ থেকেই একটি নির্দিষ্ট হারে অর্থ চলে যায় হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তার পকেটে। যে কারনে প্রথমে যোগদান করেই যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল ধীরে ধীরে তা থেকে পিছিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, উন্নয়ন করতে গেলে সামান্য ভোগান্তি সহ্য করতেই হবে।

তার হাসপাতাল তিনি কিভাবে চালাবেন সেটি তার বিষয় বলেও দম্ভ প্রকাশ করেন। পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘বাইরের লোক দিয়ে হাসপাতাল চালানোর প্রশ্ন করেন, জনবল সংকট নিয়ে লিখতে পারেন না’? #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.