নাটোরে নারদ নদ দখল হয়ে যাচ্ছে

নাটোর প্রতিনিধি: নাটোরের এককালের খরস্রোতা নারদ নদ এখন শুধু নামেই পরিচিত। নেই চলমান পানি প্রবাহের সেই রুপ। চলেনা বাম্পীয় ইঞ্জিন চালিত বড় বড় নৌকা। মানুষের নির্যাতন, নিষ্ঠুরতায় খরস্রোতা নদটি বর্তমানে মৃতপ্রায়। অবৈধ দখল, কলকারখানার দূষিত বর্জ্যসহ ভরাটের কারণে নারদ নদ এখন সরু ড্রেন হয়ে গেছে। স্রোতহীন নদটিতে এখন পানির পরিবর্তে প্রবাহিত হচ্ছে পয়প্রনালী সহ দূষিত বর্জ্য।
দখল ও দুষণে অচিরেই হারিয়ে যাবে এই নদের অস্তিত্ব।নাটোরে গত তিন বছরে তিন বার নারদ নদ থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হলেও তা আবারও দখল হয়ে গেছে। এবার ভূমিহীনদের পাশপাশি নদটি দখলে মেতেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এছাড়া শিল্প কারখানার বর্জ্যে নদটি ইতোমধ্যে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। ফলে অতিদ্রুত নদটির অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে বসেছে।
স্থানীরা জানায়, নাটোর শহর দিয়ে বয়ে যাওয়া নারদ নদের দখলদার মুক্ত করতে গত ৩ বছরে ৩ দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। তবে উচ্ছেদ অভিযানের কিছুদিন পর আবারও দখল হয়ে যায় নদের দুইপাশ। তবে চলতি বছর কোনো উচ্ছেদ অভিযান না হওয়ায় বর্তমানে নদটি দখলের উৎসব চলছে।
১৮২১ সালে পদ্মা নদীতে বন্যায় ব্যাপক জলস্ফীতি হলে উৎসমুখে বালু ও পলি জমে নারদ স্রোতহীন হয়ে পড়ে। সেবারের বন্যায় দীর্ঘদিন নাটোর জলাবদ্ধ ছিল। এই সময় থেকে নারদ নদের রাজশাহী অঞ্চলের পানিপ্রবাহ মরে যেতে থাকে।তবে নাটোর অঞ্চলের নারদ নদে পদ্মার পানি রাজশাহীর চারঘাট হয়ে বড়াল ও মুসাখান দিয়ে ঢুকছিল। রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে বড়াল নদের জন্ম হয়। বড়াল থেকে জন্ম হয় মুসাখান নদ। নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়ায় মুসাখান নদ থেকে নারদ আবার পদ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়। ভাটিতে গুরুদাসপুরের নন্দকুজা নদীতে গিয়ে মিশে নারদ নদ।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই নারদ নদকে ঘিরে প্রায় ৩০০ বছর আগে নাটোর শহরের গোড়াপত্তন হয়। নাটোরের রাজা রামজীবন ও রঘুনাথ ১৮ শতকের প্রথম দিকে এখানে তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। সেই সময়ে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে নাটোরের যোগাযোগ। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল খরস্রোতা এই নারদ নদ। এরপর ধীরে ধীরে নারদ নদের চারপাশের উর্বর ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে বসতি।বাম্পীয় ইঞ্জিনচালিত বড় বড় নৌযান এই নদ দিয়ে চলাচল করতো।
মহারানী ভবানী সহ অন্য রাজা-বাদশারা এই নদ দিয়ে কলকাতায় যাতায়াত করতেন। কিন্তু ৮০’র দশকে নারদের উৎসমুখ চারঘাটে সুইস গেট নির্মাণের ফলে নারদ মৃত নদে পরিণত হতে শুরু করে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় নদের তীর ভরাট করে শুরু হয় দখলের প্রক্রিয়া। গড়ে তোলা হয় স্থায়ী ও অস্থায়ী অবকাঠামো। ফলে কমতে থাকে নদের আয়তন।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, নারদ নদের দৈঘ্য ৪৪ কিলোমিটার। নাটোর শহরের মধ্যে এই নদের অবস্থান ৬ কিলোমিটার। যা শহরকে করে সৌন্দয্য মন্ডিত। এই নদের প্রস্থ ছিল ৬০ ফুট থেকে সর্ব্বোচ্চ ১২০ ফুট। কিন্তু কালের বির্বতনে এবং অবৈধ দখল ও দূষনের কবলে পড়ে নারদ তার অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সদর উপজেলায় নদটির প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকা দখল হয়ে গেছে। এরমধ্যে বেশকিছু অংশ দখল করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ভূমিহীনরা কাঁচা বাড়ি স্থাপন করলেও কেউ কেউ নদের জমি দখল করে বহুতল পাকা বাড়ি বানিয়েছেন। এতে ইতোমধ্যে নদটির দুই পাড়ের আয়তন কমে গেছে, নদ সরু হয়ে যাবার পাশাপাশি পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া শিল্প কলকারখানার বর্জ্য নদীর পানিকে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। শহরবাসী নারদ নদের স্থায়ীভাবে দখল মুক্ত চান।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, নারদ নদের ভূমিহীন দখলদারদের সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ৪শ পরিবারকে পুর্নবাসন করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে দখলদারদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা পেলেই প্রভাবশালীদের উচ্ছেদ করে দখল মুক্ত করা হবে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ এলে নদটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।
প্রসঙ্গত, প্রায় ৯৩ কিলোমিটারের এই নদটি রাজশাহীর শাহপুর এলাকায় পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে নাটোর সদর উপজেলার হালসা এলাকার নন্দকুজা নদীতে মিলিত হয়েছে।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.