নাটোরের লাশ কাটা ঘরের কাহিনী

মো. নাসিম উদ্দিন নাসিম: বিশেষ প্রতিনিধি: শোনা গেল লাশকাটা ঘরে, নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হল তার সাধ। বধু শুয়েছিল পাশে, শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জোছনায় তবু সে দেখিল কোন ভূত? ঘুম কেন ভেংগে গেল তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

বন্ধু হারানোর যন্ত্রণায় কাতর জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা। লাশ কাটা ঘর রয়েছে এই নাটোরেই। আগে ছিল শহরের পিটিআই জামে মসজিদ যেখানে সেখানে । আর এখন নাটোর আধুনিক হাসপাতাল ব্লিল্ডিং এর পিছনে । হাসপাতালের কোলাহলপূর্ণ কর্মব্যস্ত পরিবেশ। কেউ রোগী নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। কেউ বের হচ্ছে। কেউবা খাবার নিয়ে রোগীর কাছে যাচ্ছে।

ডাক্তার, রোগী ও রোগীর স্বজনরা সকলেই ব্যস্ত। কেউ কারও দিকে তাকানোর ফুসরতটুকুও পাচ্ছে না। সোজা ভেতরের দিকে ডায়াবেটিকস হাসপাতাল বরাবর মর্গ। এই এলাকা অনেকটা কোলাহলমুক্ত।

বামে মোড় নিয়ে মর্গ ভবনের কাছাকাছি যেতেই অন্যরকম পরিবেশ। বাতাসে লাশের গন্ধ। বাইরে স্বজনের চাপা আহাজারি। পরিবেশ একেবারে গুমোট ও ভারি। নাটোর শহরে চলার পথে নারদ নদের উৎকট গন্ধ প্রায় প্রত্যেকেই পেয়েছেন।

এমন চাপা ও ভয়ঙ্কর গন্ধের সম্মুখীন হয়তো কখনও পড়তে হয়নি। কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন কেড়ে নিয়েছে এখানে অবস্থানরত মানুষের হাসি। এখানে উচ্চস্বরে কথা বলাও যেন নিষেধ। মর্গের সামনে কিছু লোকজনও দেখা যায়। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। সবাই কারও জন্য অপেক্ষমাণ।

উপস্থিতরা কেউ লাশের পিতা। কেউ চাচা বা কাছের আত্মীয়। স্বজনদের বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নেই। রাস্তার পাশে যে যার মতো মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে কিছুক্ষণ পর কাটার জন্য ১টি থেকে ২ টি লাশ জমা হয়েছে।

একে একে বের করে পোস্টমর্টেম রুমে নিয়ে যাওয়া হবে। একটু পরেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের উপস্থিতিতে ডোমরা পোস্টমর্টেম শুরু করবেন। পোস্টমর্টেম করার সময় ডোমদের একটু মদ খেতে হয় । তাই ডোম পবন বলে, মানুয় হয়ে মানুষ কাটা খুব কঠিন কাজ নাসিম ভাই । একটু মাল না খেলে সুস্থ শরীরে কাটা যায় ।

একটা একটা করে মানুষের পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি উলটে-পালটে দেখা হবে। মাথার খুলি ফাটিয়ে মগজ বের করা হবে। কোন ইন্টার্নি ডাক্তার উপস্থিত থাকলে হয়তো ইচ্ছার বাইরেই নাক চেপে ধরে মানুষ কাটাকুটি দেখবে। আবার মৃত মানুষটির মারা যাওয়ার কারণ নিয়েও ভাববে।

তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার খুটে খুটে দেখবেন। মারা যাওয়ার আলামতগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করবেন। কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লেখার সময় এসব বিষয়গুলো লিখতে হবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে বের করা হচ্ছে লাশ। প্রত্যেকটা লাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটি যুবতীর লাশ বের করা হলো।

গায়ে থাকা ওড়না দিয়েই ঢাকা হয়েছে তাকে। হঠাৎ বাতাসে কাপড় পড়ে গিয়ে মুখ খুলে গেছে। মাথা থেকে গলা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তখনও মেয়েটির মুখে মৃত্যুর ছাপ স্পষ্ট হয়নি। ফুটফুটে সুন্দর। মুখটা কি লাবণ্য মায়া মাখা। মাথাভরা কোমর পর্যন্ত কালো চুল। যেন কোথাও বের হওয়ার জন্য কেবলই সাজ-গোজ করেছে। এরই মাঝে কারও অপেক্ষায় একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। এমন হাসিমাখা মুখ দেখে কেউ প্রথমেই ভাবতে পারবে না সে মারা গেছে।

মেয়েটির বয়স আনুমানিক ১৭-১৯। হাসপাতাল মর্গের ভিতর থেকে কেবল বের করা হয়েছে। বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের সামনে দিয়ে ট্রলিতে করে নেয়া হচ্ছে। গন্তব্য পাশেই হাসপাতাল ভবনের পিছনের লাশ কাটা ঘর। কিছুক্ষণ বাদেই ডাক্তার আসার পর লাশটা কেটে বের করা হলো। রাখা হলো মর্গের বাইরের কম্পাউন্ডে । সেই বোটকা দুর্গন্ধযুক্ত রুমে রাখা হলো।

এখানে জনসাধারণের প্রবেশ একেবারেই নিষেধ। কেউ এমন পরিবেশ দেখলে নিশ্চিত অসুস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক। কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখান থেকে লাশকে প্রথমে একটি পলিথিনে, পরে সাদা কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা হবে। স্বজনরা নিতে আসলে ওখান থেকে বের করে পাটিতে মুড়িয়ে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বেওয়ারিশ লাশগুলো ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ নিয়ে যাবে দাফন করার জন্য।

মর্গের দায়িত্বরত একজন জানালেন, ১০ বছর ধরে এখানে চাকরি করেন। প্রতিদিন লাশ আসেনা । কোন কোন মাসে ৩ থেকে ৪টা লাশ আসে। সেগুলো পোস্টমর্টেম করার পর তাদের তত্ত্বাবধানে থাকে। পবনদের পেশা লাশ কাটা। লাশ কাটতে কাটতে নিজেদের জীবনই যেন হয়ে গেছে লাশ।

সামাজিক সম্মান নেই, পাশাপাশি চাকরিও স্থায়ী নয়। “প্রথম প্রথম যখন বাবার সঙ্গে লাশ কাটার ঘরে আসতাম, খুব ভয় লাগত। বাবা লাশ কাটতেন, আমি বসে বসে দেখতাম। একদিন আমার হাতে সার্জিক্যাল ব্লেড, ছেনি ও হাতুড়ি ধরিয়ে দিয়ে ‘লাশটি কাট’ বলে বাইরে চলে গেলেন বাবা। প্রায় ২৫ বছর বয়সের মহিলা মানুষের লাশটি কাটতে গিয়ে ভয়ে হাত কাঁপছিল।

একটু পরই চিৎকার দিয়ে বাবাকে ডাকতে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। বললেন, ‘ভয় কী?’ তোর সাহস বাড়ানোর জন্য আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’ এ কথা শোনার পর সাহস বেড়ে গেল। বাবা আবার বাইরে চলে গেলে ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি কাটা শুরু করলাম।

“হাসপাতাল মর্গের ডোম পবনের লাশ কাটার শুরু এভাবেই হয়েছিল।তাঁর মতোই শুরুতে লাশ কাটতে গিয়ে ভয় পেয়েছিলেন এখন আর ভয়ডর লাগেনা ।’প্রতিদিন এই কাজ করতে করতে এখন খারাপও লাগে না, কষ্টও লাগে না, এমনকি মনের মধ্যে ভয়ডরের অনুভূতিও কাজ করে না।’এখন বড় হয়েছি।

অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। দূর হয়েছে মনের ভয়ও।’ লাশ কাটার জন্য নিযুক্ত কর্মচারীদের সাধারণ মানুষ ‘ডোম’ নামে চিনলেও লাশ কাটার দায়িত্বে নিযুক্তরা আসলে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। ঝাড়ুদার পদে চাকরি করেন । অনেকের চাকরিও নেই । লাশ কাটার জন্য ডোমদের হাতিয়ার হাতুড়ি, ছুরি, বাটাল, ব্লেড ও কাঁচি।

একটি লাশ কাটতে সময় লাগে বড়জোর ১৫ থেকে ২০ মিনিট। লাশ কাটার জন্য তাদের আলাদা কোনো সম্মানী দেওয়া হয় না। তবে লাশের মালিক পক্ষ প্রায়ই তাদের বকশিশ দেয়। আর লাশ কাটতে হয় সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই।

লাশ কাটার সময় তাঁরা পেট ভরে মদ খান আর মুখ ভরে পান খান। মদ ও পান খেলে লাশের গন্ধটা নাকে কম লাগে। হাসপাতালে কত লাশ আসে এর নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। কোনো দিন লাশ আসে।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি মো. নাসিম উদ্দিন নাসিম। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.