নওগাঁ সরকারি গণগ্রন্থাগারে ফিরেছে প্রাণ

নওগাঁ প্রতিনিধি: বই পড়ার আগ্রহ বেড়েছে পাঠকদের। ফলে নওগাঁ সরকারি গণগ্রন্থাগারে ফিরেছে প্রাণ। পাঠকদের পদচারণায় লাইব্রেরীটি যেন প্রাণচাঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে শিক্ষার্থীদের খুঁজেই পাওয়া যেত না আজ সেখানে বসার জায়গা পাওয়াই ভার। এখানে কেউ আসেন বইয়ের টানে। আবার কেউ বা খবরের কাগজ পড়তে। তবে জেলা প্রশাসকের ব্যতিক্রম উদ্যোগ ‘পাঠক ফোরামের’ কারণেই লাইব্রেরীটিতে প্রাণ ফিরেছে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।

জানাগেছে, ১৯৮২ সালে ১ জানুয়ারী শহরের কালীতলায় হোয়াইট হাউজের দ্বিতীয় তলায় লাইব্রেরীর যাত্রা শুরু হয়। শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় পাঠকদের আনাগোনাও ছিল কম। এছাড়া পড়াশুনার পরিবেশও তেমন একটা ছিলনা। ফলে লাইব্রেরী একসময় পাঠকশুন্য হয়ে পড়ে। এরপরে ২০১১ সালে শহরের দয়ালের মোড়ে লাইব্রেরীটি স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে লাইব্রেরীতে ৩৫টি সেলফে রয়েছে প্রায় ২৭ হাজার বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনি, গল্প, উপন্যাস, ইসলামীক, একাডেমীক ও ছোটদের ছড়াসহ বিভিন্ন বইয়ের সমাহার। লাইব্রেরীতে একজন প্রথম শ্রেনীর লাইর্বেরীয়ান, একজন সহকারী লাইব্রেরীয়ান, একজন জুনিয়র লাইব্রেরীয়ান ও একজন এমএলএস আছেন। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া বৃহস্পতি ও শুক্রবার বন্ধ থাকে।

বতর্মান সময়ে বেড়েছে হাতে হাতে মুঠোফোন। আর সেই সাথে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াইটস অ্যাপ ও ইউটিউব এবং গেম খেলার দিকে ঝুঁকছে শিশু থেকে শিক্ষিত বেকাররা। ফলে দিনের বেশির ভাগ সময় ইন্টারনেট ও গেম খেলতে কেটে যায়। এতে বইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা। তবে মোবাইলে শত ব্যস্ত মাঝেও নওগাঁ সরকারি গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। ফলে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে এ গণগ্রন্থাগারটি। যেন এক অন্যরকম দৃশ্য। শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের জন্যই লাইব্রেরীটি প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। জ্ঞান অর্জনে পড়ার যেমন বিকল্প নাই। তেমনি পাঠাগারেরও বিকল্প নাই।

যেখানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থাকে শিক্ষার্থী, বেকার যুবক-যুবতী ও অন্যান্য পাঠকদের আনাগোনা। যে যার মতো করে কেউ বই পড়ছেন। কেউ নোটবুকে গুরুত্বপূর্ন বিষয়টি নোট করছেন। আবার কেউ পত্রিকা পড়ছেন। লাইব্রেরীতে একটি পাঠক ফোরাম গঠন করা হয়েছে। যেখানে সপ্তাহে দুইদিন ক্লাস এবং পরীক্ষা হয়। শিক্ষার্থীরা যে যে বিষয়ের উপর পড়াশুনা করেছে মুলত তারাই ক্লাস নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন প্রায় দুইশ পাঠকের আগমন ঘটে। লাইব্রেরীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কর্ণার। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। পাঠক সহজেই এ বিষয়ক তথ্য পেতে পারে।

নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স করা মনিরুল ইসলাম বলেন, লাইব্রেরীতে বসে পড়াশুনার জন্য আমরা সুন্দর একটা পরিবেশ পাই। যা ছাত্রাবাসে হয়না। লাইব্রেরীতে বঙ্গবন্ধু, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ চাকুরির বিভিন্ন বই পাওয়া যায়। আমরা যারা নিয়মিত লাইব্রেরীর পাঠক তাদের মধ্য থেকে আলাদা আলাদা বিষয়ে ক্লাস করানো হয়। গ্রুপ ভিত্তিকও পড়াশুনা করা হয়। লাইব্রেরীর দায়িত্ব যারা আছেন তারা আমাদের সার্বিক সহযোগীতা করে থাকেন।

২০১৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স করা মাহতাব আলী বলেন, চাকুরির বই পড়ার পাশাপাশি বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনি পড়ি। লাইব্রেরী সাপ্তাহিক দুইদিন রবিবার ক্লাস এবং বুধবার পরীক্ষা হয়ে থাকে। এটার জন্য সার্বিক সহযোগীতা করেছেন জেলা প্রশাসক মো: মিজানুর রহমান স্যার। মূলত তিনি পাঠক ফোরাম গঠন করে দিয়েছেন আমাদের সুবিধার জন্য। অনেক সময় তিনি নিজেও আমাদের ক্লাস করান। বিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিসহ দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেনীর চাকুরির প্রস্তুতি জন্যই লাইব্রেরীতে এসে নিয়মিত পড়াশুনা করা হয়।

 

২০১৫ সালে বাংলা থেকে মাস্টার্স করা ফাতেমা বানু বলেন, লাইব্রেরীতে অনেক বই আছে যা ব্যক্তিগত ভাবে কিনে পড়া সম্ভব নয়। যার কারণে চাকুরি বইয়ের পাশাপাশি পত্রিকা, উপন্যাস, আত্মজীবনি বইগুলো পড়ি। প্রতিদিন সময় করে লাইব্রেরী আসি।

অর্নাস প্রথম বর্ষের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা তন্ময় বলেন, একাডেমীক পড়াশুনার পাশাপাশি লাইব্রেরীতে এসে গল্পের বই পড়া হয়। বই পড়তে ভাল লাগে। মূলত জ্ঞান অর্জনের জন্যই লাইবেরীতে আসা হয়।

নিয়মিত পত্রিকার পাঠক মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, বাড়িতে সব পত্রিকা কিনে পড়া সম্ভব না। যার কারণে লাইব্রেরীতে সকালে এসে পত্রিকা পড়ি। বিশেষ করে কলাম, খেলার পাতা ও আন্তর্জাতিক পাতা পড়তে ভাল লাগে।

লাইব্রেরীর নিয়মিত পাঠক বাসদনেতা জয়নাল আবেদীন মকুল। তিনি বলেন, নওগাঁ শহরে যে পরিমাণ জনসংখ্যা সে তুলনায় লাইব্রেরী বা পাঠাগারের সংখ্যা খুবই কম। এছাড়া স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর তুলনায় পাঠাগার কম। এ লাইব্রেরীতে যাদের দেখছি বেশির ভাগই বেকার। মাস্টার্স শেষ করে চাকরির জন্য এসে পড়াশুনা করছে। আজকে বাংলাদেশে চাকুরির ক্ষেত্রে যে সংকট চলছে, যে পরিমাণ পড়াশুনার দরকার তা হয়না। আমি মনে করি দেহ মনে বিকশি হতে যেমন খেলার মাঠ দরকার, তেমনি পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার হওয়া দরাকার।

নওগাঁ জেলা সরকারি গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান এসএম আশিফ বলেন, দিন দিন পাঠক সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে স্থান সংকুলানেরও সমস্যা হচ্ছে। ফলে উর্ধ্বমূর্খী সম্প্রসারণের যে প্রকল্প আছে সেটি পাশ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। যেখানে শিশুদের জন্য আলাদা পাঠ কক্ষ, বয়স্ক ও মহিলাদের পড়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। এতে করে পাঠকদের আর সমস্যা হবেনা।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছি। কি ধরনের সুবিধা পেলে তারা লাইব্রেরীতে আসতে আগ্রহী। পাঠকদের চাহিদা মোতাবেক বই সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

নওগাঁ জেলা প্রশাসক মো: মিজানুর রহমান বলেন, পাবলিক লাইব্রেরীতে যথাযথ ব্যবহারের জন্য পাঠক ফোরাম গঠন করা হয়েছে। বই পড়ার পর সেখানে কুইজ ও রচনা প্রতিযোগীতার মাধ্যমে এক আনন্দ মুখর পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। এতে করে সেখানে দিন দিন পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।#

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নওগাঁ প্রতিনিধি মো: আব্বাস আলী।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.