নওগাঁর বেলালের মহাকান্ড এলাকাজুড়ে রোপন করেছেন ১ লাখ তালের আঁটি’সহ ১০ হাজার গাছের চারা

বিশেষ প্রতিনিধি: সকল প্রকার দিধা দন্দ আর সঙ্কোচকে ঝেড়ে ফেলে মানবতার কল্যানে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নওগাঁয় তাল বেলাল। মাথায় তীব্র রোদ, বাইকের পিছনে তাল সংগ্রহের জন্য বস্তা বেধে গ্রামে গ্রামে ছুটে চলেছেন তিনি। গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্ধান করছেন তালের আঁটি। কখনো টাকা দিয়ে আবার কখনো বুঝিয়ে কারো গাছ থেকে পাকা তাল কখনো কারো বাড়ী হতে তালের আঁটি সংগ্রহ করেন দিনের পর দিন।
অনেক বাড়ি থেকে বলা হয় বাচ্চারা তালের আঁটির শাষ খাবে আটি দেয়া যাবেনা। কিন্তু নাছোড়বান্ধা মাহমুদুন নবী বেলাল। তবে এখন তাকে ‘তালবেলাল’ বলে চেনে নওগাঁর আনাচে কাচের আবাল বৃদ্ধ ছোট বড় সবাই। তাল বেলাল কৌশলে বাচ্চাদের বলে এবার ওই আটি ক’টা দিয়ে গাছ লাগানো হবে। পরের বছর না হয় তালের আঁটির শাষ খাবে বাচ্চারা। কেউ শুনে দিয়েছেন আবার কেউ না জবাব দিয়েছেন।
কিন্তু তার লক্ষ্য তিনি নওগাঁ-রাজশাহী অভ্যন্তরিন মহা-সড়কের সান্তাহার বশিপুর হতে মোহনপুরের কামারপাড়া পর্যন্ত ১ লক্ষ তালের আঁটি রোপনে শত ভাগ সফল করেরেই ছাড়বেন। সে আশা আজ তিনি বাস্তবায়ন করেছেন একক প্রচেষ্টায়। ২০১৭ সাল থেকে তিনি তালের আঁটি রোপন শুরু করেছেন। এখন অনেক তাল বাগনের অনেক তাল গাছ মাটি ভেদ করে গাছ ২ থেকে ৩/৪ ফিট উচু হয়ে পাতা মেলে রাস্তার সোভা বর্ধন শুরু করেছে।
আর ৩য় বারের মতো রোপিত নতুন আঁটি গুলো থেকে কিছু দিনের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলেই পাতা মেলতে শুরু করবে। এছাড়া নওগাঁ রাজশাহী মহ-সড়কের নওহাটা মোড় হতে রানীপুকুর পযর্ন্ত প্রায় ৫কিঃ মিঃ রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও সোভা বর্ধন প্রায় ১০ হাজার গাছের চারা ব্যাক্তিগত উদ্যেগে রোপন করেছেন।
একদিন দুপুরে বাইকে চেপে ধূলো উড়িয়ে গ্রামের বাড়ি মান্দা উপজেলার ভালাইন ইউনিয়নের বৈলশিং গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন তিনি। বরেন্দ্র এলাকায় সড়ক পথে ধূলো উড়বে এটাই স্বাভাবিক। হয়তো গন্তব্য স্থলে গিয়ে নিজের চেহারাটাই চেনা শক্ত হয়ে পড়বে লাল মাটির ধূলোর প্রলেপে। এভাবেই যাওয়া আসার পথে তাঁকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলছিলো একটি বিষয়। এই সড়ক গুলোয় ও গ্রাম গুলোয় আগে শত শত তাল গাছ ছিলো।
ফলের মৌসুমে গাছ গুলোয় তাল ঝুলতো। পাকা তালের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো এলাকা জুড়ে। এখন সে দিন আর নাই। তখন এলাকায় বজ্রপাতে মানুষ নিহতের ঘটনাও কদাচিৎ ঘটতো। কিন্তু এখন তো প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। তাল গাছ বজ্রপাত প্রতিরোধক এটা এখন সকলেই জানে। কিন্তু তালগাছ বেচে টাকা পকেটে পুড়েছেন অনেকে। এর ভাল দিকটি কেউ কখনো ভেবে দেখেনি। এখন এ বিষয়ে সকলেই সচেতন।
মাহমুদুন নবী বেলাল পেশায় একজন গণমাধ্যম কর্মী (সাংবাদিক), কর্মসূত্রে থাকতে হয় নওগাঁ শহরে। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে মান্দা ফেরীঘাট হতে নিয়ামতপুর সড়কের গাবতলী পর্যন্ত যে ৫ হাজার ৫’শত তাল গাছ লাগানো হয়েছিল সে গুলো ৩/৪ ফিট উচু হয়ে এখন দৃশ্যমান।
এই কাজ করতে গিয়ে গোপনে তিনি তাঁর পৈত্রিক কৃষি ধানের জমি বন্দক রেখেছেন। তবুও তিনি তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে থেমে থাকেননি। ওই তালের আঁটি সংগ্রহ করতে প্রয়োজন হয়েছিল অনেক বস্তা ও শ্রমিকের। তবে তা সংগ্রহ করা ততটা সহজ ছিলনা। আঁটি গুলো রোপনে তিন বছর ধরে দিন মুজুরিতে ১ থেকে প্রায় দেড় মাস ধরে শ্রম দিয়েছে তাল বেলালের গ্রামের বাড়ী মান্দা উপজেলার বৈলশিং ও ঘাটকৈর গ্রামের বাবলু হোসেন ও নেপালের নেতৃত্বে ১৫/১৭জন আদিবাসী যুবক।
তিনি পথে পথে ঘুরতে গিয়ে অনেক সময় সংসারের খোঁজও রাখতে পারছিলেন না । তাল আঁটি রোপনে তাকে সর্বক্ষনিক মানসিক ভাবে প্রেরণা দিয়েছেন তার বাবা স্বস্থ্য বিভাগের অবসর প্রাপ্ত কর্মকতা ইব্রাহিম হোসন ও তাল বেলালের স্ত্রী মৌসুমী খাতুন এবং তাল বেলালের শ্বশুর বাড়ীর লোকজন সহ তার শুভাকাঙ্খিরা।
প্রায় ৭৫ কিলোমিটার সড়কের দু’ধারে ওই মহাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে কত টাকা তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে সে কথা জানাতে তিনি টাকার হিসাব জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এখনও তিনি নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। যে সড়কে সেই তালবুড়ো গহের আলী তালগাছ রোপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলেন সেই ফলবতী তাল গাছ গুলো এখন আর নাই।
সড়ক প্রসস্থ করতে গিয়ে সব তালগাছ গুলো কাটা পড়েছে। সেই গহের আলীও চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সেই তালগাছ কেটে ফেলায় হারিয়ে গিয়েছে সেই প্রাকৃতিক সুন্দর্য আর সেই সাথে বৈচিত্র। বেলাল যখন তালের আঁটি রোপন করছিলেন তখন তিনি গহের আলীর রোপন করা তালগাছের শুন্যস্থানে আবারো রোপন করেছেন তালের আঁটি। হয়তো সেই গাছ গুলো বড় হতে সময় লাগবে।
কিন্তু বেলালের প্রচেষ্টায় একদিন গহের আলীর সেই স্থানে তালগাছ গুলো আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এমন বিশ্বাস তাল বেলালের। এতো গুলো তালের আঁটি সংগ্রহ করা সহজ ছিলনা। কখনো কখনো পরিপক্ক  তাল গাছ থেকেও নামাতে হয়েছে। এই কাজে মোটা শক্ত বড় রশি ব্যবহার করতে হয়েছে। দেখাগেছে রশি সংগ্রহ করা হলো কিন্তু গাছে উঠবে কে? রেজোয়ান ও নিশি, তুহিন ও হাফিজুর সহ ৫/৬ জন উদ্যোমী তরুণ এগিয়ে এলো সেই কাজে।
ছোট-খাটো পাতলা রেজোয়ান ও নিশি, তুহিন ও হাফিজুর আনায়াসে তরতর করে তালগাছে উঠে যেতো। গাছের মাথায় চড়ে তালের বাধা কেটে সেই বাধা রশির মাথায় বেঁধে ধীরে ধীরে নামিয়ে দিতো রেজোয়ান। গাছ থেকে তাল নামাতে গিয়ে একবার ভীমরুলের তাড়া খেয়ে পানিতে লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়েছে নিশিকে।
আবার একটু বৃষ্টি হলে আঁটি পরিবহনে ব্যহৃত গাড়ি লাল আঠালো মাটিতে আটকে যেতো। এমনও হয়েছে সব তাল নামিয়ে গাড়িটিকে টেনে তুলতে হতো। এটা ছিলো সেই কর্মযজ্ঞের বিড়ম্বনা। বেলাল শুধু তাল আঁটি রোপন করেন না। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো ও শিক্ষার্থিদের মাঝে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করেন।
মাহমুদুন নবী বেলাল কাজের ফাঁকে একদিন দুপুরে শহরে তাঁর ছোট্ট আফিসে বসে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলেন মানুষের চলার পথে টাকা পয়সা বড় কথা নয় মানুষের মাঝে স্মৃতি হয়ে থাকতে চায়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গত তিন চার বছর থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে ও রাস্তার পাশে তালবীজ রোপনের পাশা পাশি নওগাঁ রাজশাহী মহ-সড়কের নওহাটা মোড় হতে রানীপুকুর পযর্ন্ত প্রায় ৫কি: মিঃ রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও সোভা বর্ধন প্রায় ১০ হাজার গাছের চারা ব্যাক্তিগত উদ্যেগে রোপন করে নিয়মিত গাছ পরিচর্জার জন্য ভিমপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলাম নামের ১জন পাহারাদার তাল বেলালের নিজ বেতনে রেখেছেন।
এছাড়া নওগাঁ কোর্ট চত্বরের সামনেও বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও সোভা বর্ধন ২শতাধিক গাছের চারা রোপন করে নিজেই নিয়মিত পরিচর্জা করে সকলের মন কেড়েছে। গত ৩ বছর ধরে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার রাস্তায় ১ লাখ করে তালবীজ রোপন করেছেন তিনি।
বেলাল বলেন এ কাজে যারা আমাকে সহযোগীতা করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করছি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তালবীজ রোপনে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের বৃত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমার ইচ্ছে আগামীতে নওগাঁ সদর উপজেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিনা মূল্য রোপনের জন্য বিতরণ করবো।
এ লক্ষে নিজস্ব ভাবে প্রায় ৩০ হাজার গ্রাছের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এছাও কৃষি ও বন বিভাগকে তাক লাগিয়ে ৫হাজার তালের গাছের চারা করা হয়েছে। এলাকার সকলকে কম পক্ষে ৫টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপনের জন্য আকুল আবেদন করছি। সেই সাথে সরকারি ভাবে বেশি বেশি গাছের চারা বিতরেন উদ্যোগ নেয়ার জন্য সংশিষ্টদের নিকট জোর দাবী জানান তিনি। এমন মহৎ উদ্যোগ নেয়ায় সাংবাদিক মাহমুদুন নবী বেলালকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নওগাঁ সদর আসনের সংসদ সদস্য ব্যরিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন, মহাদেবপুর বদলগাছী আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, জেলা ও পুলিশ প্রশাসন’সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।
সাধুবাদ জানিয়ে তারা বলেন, এরকম শ্রম দিয়ে দেশের সেবা করার মতো মানুষের আজ কাল খুবই অভাব আর তাল গাছ একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। এ গাছটি দীর্ঘ সময় নিয়ে বড় হয়। তাল গাছ রাস্তার পাশে যেমন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তালগাছ। আশঙ্কা জনক হারে বজ্রপাত বেড়ে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ধারনা করা হচ্ছে- পরিবেশ থেকে তালগাছ হারিয়ে যাওয়ায় বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দূর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে মাঠে কাজ করতে গিয়ে কৃষকরা বজ্রপাতে হতাহতের শিকার হচ্ছেন। বজ্রপাত বেশী আঘাত হানে সাধারণত উঁচু গাছে।
এদিক থেকে তালগাছ বজ্রপাতের ঝুঁকি কমায়। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন, রাস্তার পশের মাটির ক্ষয়রোধ, অনাবৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় তালবীজ রোপনের গুরুত্ব দিয়ে প্রধান মন্ত্রী সকল বিভাগকে এই গাছ রোপনের নির্দেশ দেন। এছাড়া তাল গাছ সৌন্দর্য্য বর্ধন করবে, তালগাছ বড় হলে এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। যেমন তাল পাখা, (তাল কুর) কাঁচা তালের শাস, পাকা তালের পিঠা, তালের সু-মিষ্ঠ গুড় ও আঠি হতে শাস এবং পিঠা খেয়ে থাকি।
উল্লেখ্য, প্রথম তাল বীজ রোপনের উদ্ধোধন করেন তৎকালিন পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন ও ২য় দফায় নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর/বদলগাছী আসানের সাংসদ ছলিম উদ্দিন তরফদার তালবীজ বোপন কার্যকমের শুভ উদ্ধোধন করেন এবং ৩য় দফায় এই কর্মসূচীর উদ্ধোধন করেন করেন নওগাঁ সদর আসনের সাংসদ ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন এবং ৪র্থ দফায় ২০২০ সালে মহাদেবপুরের ভীমপুর ফয়েজ উদ্দিন কোল্ডষ্টোর এর সামনে পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া শুভ উদ্ধোধন করেন।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর বিশেষ প্রতিনিধি রুহুল আমীন খন্দকার। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.