ধাক্কা খেয়েও বাংলায় হাল ছাড়েনি বিজেপি

(ধাক্কা খেয়েও বাংলায় হাল ছাড়েনি বিজেপি–ছবি: প্রতিনিধির)
কলকাতা-হাওড়া (পশ্চিমবঙ্গ) প্রতিনিধি: অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে, অনেক অঙ্ক কষেও এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা দখলের স্বপ্ন সফল হয়নি বিজেপির। কিন্তু বাংলার শাসন ক্ষমতা ভোগের স্বপ্ন যে সযত্নে লালন-পালন করতে চায় তারা,তা প্রমাণিত হলো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার রদবদল এবং সম্প্রসারণে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তার প্রতিফলনের মধ্যে দিয়েই। হোক না প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব, কিন্তু বেছে বেছে যে ৪ জনকে মন্ত্রী করা হয়েছে এবং যে সব গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর তাঁদের দেওয়া হয়েছে, তা থেকে অন্তত একটা বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে এখনও অবিচল গেরুয়া শিবির। এবং সেই লক্ষ্যপূরণের জন্যই খুব ঠান্ডা মাথায় ঘুঁটি সাজাচ্ছে বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব।
নেপথ্যে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অসাধারণ দূরদৃষ্টি এবং বাস্তববাদী মনোভাব।
প্রথমেই আসা যাক নিশীথ প্রামাণিকের কথায়। কোচবিহারের এই সাংসদের সঙ্গে বিজেপি-র সম্পর্ক আদৌ কিন্তু দীর্ঘদিনের নয়।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তারপরে জনতার রায়ে শুধুমাত্র লোকসভায় প্রতিনিধিত্বের ছাড়পত্রই পাননি, কোচবিহার সহ গোটা উত্তরবঙ্গে তীব্র মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের।
জনপ্রিয়তা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে দ্রুত আস্থা অর্জন করেছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। এবারে বিধানসভা নির্বাচনেও দিনহাটা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হারিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থীকে।
তবে সাংসদ পদে থাকার জন্য আইন মেনে কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেন বিধায়ক পদ। সেই নিশীথ প্রামণিককে দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ।
অর্থাৎ মোদী মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ডেপুটি হিসেবে কাজ করবেন তিনি। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট, পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল তৃণমূলকে রীতিমতো চাপে রাখা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টা রাজ্যের এক্তিয়ারে থাকলেও বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ অস্বাভাবিক নয়।
বিশেষ করে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ও পরে বারবারই সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও বিধানসভার বিরোধী দলনেতা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং বারবারই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবী করেছেন। দরবার করেছেন দিল্লিতে।
রাষ্ট্রপতি শাসনেরও দাবী উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন অমিত শাহর ডেপুটি হিসেবে নিশীথকে মন্ত্রীসভায় জায়গা দেওয়া নিঃসন্দেহে একটা সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল- তৃণমূলকে চাপে ফেলে দেওয়ার পক্ষে যা যথেষ্ট। এরই পাশাপাশি নয়া মন্ত্রিসভার অন্যতম কনিষ্ঠ প্রতিনিধি নিশীথকে ক্রীড়া এবং যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব দিয়ে বাংলার যুবসমাজের মন পেতে চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। নিশীথের এই উত্থানে রাজবংশী সমাজ যে বিজেপি-র দিকে আরও ঝুঁকে পড়বে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লাকে মন্ত্রীসভায় জায়গা দেওয়া গেরুয়া ব্রিগেডের এক বিশেষ কৌশল। উত্তরবঙ্গের চা-বাগান শ্রমিক এবং আদিবাসীদের মধ্যে বার্লার প্রভাব প্রশ্নাতীত। তাঁর দৌলতে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র সাফল্যের ধারা সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনেও অব্যাহত আলিপুরদুয়ার তথা ডুয়ার্সে। এরই পুরস্কার কেন্দ্রের মন্ত্রীসভায় বার্লার অন্তর্ভুক্তি।
তিনি এখন সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই খুশির বন্যা আদিবাসী সমাজে। আশায় বুক বাঁধছেন চা-শ্রমিকরা। কিছুটা আশার আলো দেখছেন সংখ্যালঘুদের একাংশ। কিন্তু বার্লার এই উত্থান উস্কে দিয়েছে সাম্প্রতিক এক বিতর্ককে। আসলে কিছুদিন আগেই উত্তরবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ এনেছিলেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ। শুধু অভিযোগ নয়, বঞ্চনামুক্তির লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ারও দাবী তোলেন তিনি।
তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয় এই নিয়ে। তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, “বাংলা ভাগের চক্রান্ত রুখবই।” আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল নেতা সৌরভ চক্রবর্তীও ক্ষোভে ফেটে পড়েন বার্লার বিরুদ্ধে। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য খোলাখুলিই জানিয়ে দেন বাংলা ভাগের দাবীর সঙ্গে দল একমত নয়। তবুও সেই জন বার্লার এমন গুরুত্ব বৃদ্ধিতে বিস্মিত তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটাও আসলে মমতাকে চাপে রাখার একটা কৌশল কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের।
বনগাঁর বিজেপি সাংসদ মতুয়া মহাসঙ্ঘের নেতা শান্তনু ঠাকুরকে মোদীজির নতুন টিমে অন্তর্ভুক্ত করার তাৎপর্য কিন্তু বেশ গভীর। তাঁকে দেওয়া হয়েছে জাহাজ,জলপথ প্রতিমন্ত্রীকের দায়িত্ব। লক্ষ্যণীয়, এই মতুয়া সম্প্রদায়ের শিকড় আসলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান,অধুনা বাংলাদেশে।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা এবং নদীয়ার অধিকাংশ বিধানসভা কেন্দ্রের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটারের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব এই মতুয়া সম্প্রদায়ের। তাই তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস তো বটেই সিপিএমও মতুয়াদের সমর্থন পেতে উদগ্রীব।
প্রায় এক দশক ধরে তৃণমূলের দিকে মতুয়া সম্প্রদায় সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিলেও, ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন থেকে কিন্তু ঘুঁটি উলটে যায়। ভারতে যে স্থায়ী নাগরিকত্বের দাবিতে মতুয়ারা দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই দাবি পূরণের আশায় তাঁদের একটা বড় অংশই ঝুঁকে পড়েন বিজেপি-র দিকে। বনগাঁর সাংসদ নির্বাচিত করেন বিজেপি-র শান্তনু ঠাকুরকে।
কিন্তু সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর না হওয়ায় এবারের বিধানসভা ভোটের আগে আবার বেঁকে বসেন তাঁরা। অভিমানে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দুরত্ব তৈরি করেন সাংসদ শান্তনু।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর হস্তক্ষেপে অবশেষে বরফ গলে। একমাত্র স্বরূপনগর বিধানসভা কেন্দ্র ছাড়া বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বাকি সবকটা বিধানসভা কেন্দ্রেই ব্যাপক সাফল্য পায় বিজেপি। সেই সাফল্য ধরে রাখতেই শান্তনুকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর।
এতো গেল নব্য বিজেপি-দের উত্থানের কাহিনি। আদি বিজেপি-দের খুশি করার জন্য মন্ত্রিসভায় সাদরে জায়গা দেওয়া হলো বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকারকে। সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ সুভাষবাবু পেশায় চিকিৎসক। দল-বদলু নন। বিজেপি-র সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সুবাদে পেলেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সম্মান।
আসলে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলে বিজেপির সাফল্যের স্রোত কিছুটা গতি হারিয়েছে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে। কিছুটা ব্যতিক্রম অবশ্যই বাঁকুড়া এবং এই জেলারই বিষ্ণুপুর। জঙ্গলমহল এবং রাঢ়-বঙ্গের মাটি ধরে রাখতেই সম্ভবত পুরস্কৃত করা হলো সুভাষ সরকারকে। কিন্তু মন্ত্রী হতে না পেরে রীতিমতো অভিমানী হয়ে উঠলেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ যুবনেতা সৌমিত্র খাঁ।
সব মিলিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট, এবারে বিধানসভা নির্বাচনে ধাক্কা খেলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে কিন্তু আদৌ হাল ছাড়েনি বিজেপি। বরং আরও শক্ত হাতে তারা ধরতে চায় বঙ্গ-রাজনীতির হাল। সামনের পুর নির্বাচন, পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এখন থেকেই তাই ঘুঁটি সাজাচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। গতকাল বুধবার (০৭ জুলাই) কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়েই প্রতিফলিত হলো সেই মনোভাব।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ (বাংলাদেশ) এর কলকাতা-হাওড়া (ভারত) প্রতিনিধি সৌম্য সিংহ। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.