দু’দফা পেছালো তদন্ত প্রতিবেদন দেবার সময়, নাটোরে মেডিকেল রিপোর্ট আনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার শতাধিক নারী

নাটোর প্রতিনিধি: দু’দফা পেছানো হয়েছে নাটোরের লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন দেবার সময়সীমা। গত ১ জুন তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে কমিটি। ১৩ জুন প্রতিবেদন দেবার কথা থাকলেও তা দুই দফায় সময় সীমা বাড়ানো হয়। এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, সুইটি রানী তদন্ত কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ করতে প্রবাবশালীদের মাধ্যমে অপতৎপরতা শুরু করেছেন।
জানা যায়, নাটোরের লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের জন্য মেডিকেল রিপোর্ট আনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন শতাধিক সন্তানসম্ভাবা নারী।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মেডিকেল রিপোর্ট আনতে ঐ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তারা। পরে সুইটি রানী তাদের পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের চকরামপুর এলাকার একটি ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি একগাদা পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে গরীব অসহায়দের চার লক্ষাধিক টাকা।
বিভিন্ন বিটিসি নিউজ সহ গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের কর্মকর্তা। পরে গত ১ জুন থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে কমিটি। তারই অংশ হিসাবে লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালুর উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে ৫ ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনদের সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর তদন্ত কমিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীরও জবানবন্দি গ্রহন করে।
সদর উপজেলার গাজিপুর বিল এলাকার জরিনা খাতুন জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের আবেদনের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্টের জন্য কিছুদিন আগে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা সুইটি রানীর দারস্থ হন তিনি। পরে সুইটি রানী তাকে পাঠিয়ে দেন ‘হেলথ কেয়ার’ নামে শহরের একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। সেখানে আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই একগাদা পরীক্ষা করে নেয়া হয় ১৬শ টাকা।
একই অভিযোগ করেন, পাশ্ববর্তী আটঘরিয়া গ্রামের গৃহবধু শাহিদা। তিনি জানান, বনপাড়ার জাহেদা হাসপাতাল থেকে তিনি আলট্রাসনোগ্রাফি করান। সেই রিপোর্ট নিয়ে সুইটি রানীর কাছে গেলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগের কাগজপত্র চলবে না বলে জানান সুইটি। পরে হেলথ কেয়ারে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় ২৫শ টাকা। পুরো ইউনিয়নে সাথী, পাপিয়া, জেসমিন, আঁখি, লাইলি, আলেয়া সহ ১৩২ জন নারীর সাথে একই ঘটনা ঘটেছে দাবী করে ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানিয়েছেন রোগীর স্বজন ও এলাকাবাসি। এ নিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছিল ভুক্তভোগীরা।
সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ পরিতোষ কুমার রায় জানান, একজন নারী সন্তানসম্ভাবা কিনা তা জানার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এতোগুলো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র মুত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই বিষয়টি জানা যায়। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য বড়জোড় আলট্রাসনোগ্রাফি করা যেতে পারে। এছাড়া সংশ্লিষ্ঠ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া স্বাস্থ্য পরিক্ষা করারও বিধান নেই।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এতোগুলো পরীক্ষা কেন করানো হলো? সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ইসমাইল হুসাইনের কাছে। তবে সুইটি রানীর সাথে সংখ্যতার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন তিনি।
ডা. ইসমাইল হুসাইন জানান, রোগীরা এসে যে যে পরীক্ষা করতে বলেছে আমরা শুধু সেই পরীক্ষাগুলোই করেছি। সুইটি রানী স্বাস্থ্য সেক্টরে একজন সরকারী কর্মকর্তা। এই হিসাবে ওনার সাথে আমাদের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। ওনি প্রয়োজন মনে করলে অনেক সময় তার পরিচিত জনকে আমাদের এখানে চিকিৎসার জন্য পাঠান।
নিজের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবী করছেন অভিযুক্ত সুইটি রানী। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্য ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমুলক। তিনি কাউকে হেলথ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠাননি।
এবিষয়ে লক্ষীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান কালু জানান, ইতিমধ্যে ঘটনাটির সমাধান চেয়ে তার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। ঘটনাটি পরিষদের মাসিক সভায় আলোচনা করে কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের দেয়া মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতেই মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ডের আবেদন করা যায়। গরীব অসহায় দুঃস্থ গর্ভবতী নারীদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সুইটি রানী ন্যাক্কারজনক কাজ করেছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবী জানান তিনি।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মোসাঃ মাহফুজা খানম জানান, মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের প্রয়োজনে মেডিকেল রিপোর্ট করাতে শতাধিক নারী সুইটি রানীর কাছে যায়। এসময় সুইটি রানী তাদের পাঠিয়ে দেন হেলথ কেয়ার নামে শহরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই আল্ট্রাসনোগ্রাফিসহ অপ্রয়োজনীয় একাধিক পরীক্ষা করে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ বিষয় ভুক্তভোগীরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বর সভায় আলোচনা হয়।
এরই প্রেক্ষিতে জেলা পরিবার পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কনট্রাসেপসনের সহকারী পরিচালক আব্দুর রউফ মল্লিককে আহবায়ক এবং সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান খানকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ১৩ জুন প্রতিবেদন দেবার জন্য বলা হয়। তবে তদন্ত কমিটির আহবায়ক অসুস্থতার কথা বলে দুই দফা সময় বাড়িয়ে নিয়েছে।
তদন্ত কমিটির আহবায়ক জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কনট্রাসেপসনের সহকারী পরিচালক আব্দুর রউফ মল্লিক জানান, ১৩ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত কার্যক্রম শেষ না করায় তা বাড়িয়ে প্রথমে ২০ জুন ও পরে ২৬ জুন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই তারিখের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তদন্তে কোনরুপ প্রভাব বিস্তারের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর নাটোর প্রতিনিধি খান মামুন। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.