দিনাজপুরের কাঞ্চন নদীতে ‘রানিশংকৈলের শহীদ নফিজ উদ্দিন’কে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেন পাকসেনারা !

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রানীশংকৈল উপজেলার প্রথম শহীদ নফিজ উদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেন পাকিস্তানী সেনারা।যে কথা শুনলে আজও গাঁ কাটা দিয়ে ওঠে। রানীশংকৈলে মুক্তি যুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয় যার হাত দিয়ে তিনি শহীদ নফিজ উদ্দিন মাষ্টার।সেদিন বাঙালি জনগণ পাকিস্তানি শাসকদের এই অন্যায় আইন মেনে নিতে পারেনি।

মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য বাঙালিরা আন্দোলন শুরু করে। রানীশংকৈলে সে সময় একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে শহীদ নফিজ উদ্দিন আহমেদও আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যা গরিষ্ঠ বাংলাভাষী জনগণ মুসলিম হলেও এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু-বাঙালি বাস করত। খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ উর্দুতে কথা বলতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভ করা এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পৃথক দুটি আলাদা ভূখন্ডের সৃষ্টি হয় যা বাংলার মানুষের অজানা নয়। পশ্চিমাংশের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি মুসলিমদেরকে ‘অতি বাঙালি’ হিসেবে দেখতো এবং তাদের মুসলমানিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতো।

আর এই কারণে তারা বাঙালিদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করতো না। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী জোরপূর্বক সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদেরকে পাকিস্তানিদের মত তৈরি করার চেষ্টা শুরু করে দেয়।সে কারনে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙালিরা ভাষার দাবিতে রক্ত দেয় যা বিশ্ব ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে সুপরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগের বিকল্প হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।যার ফলে পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তন করে আওয়ামীলীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তী দেড় দশক ধরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শক্তির প্রতিপক্ষ হিসেবে বাঙালি জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক পটভূমিতে আত্মপ্রকাশ করে। আবারও ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা শুরু করে। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। বিপুল ভোটে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই ফল মেনে নিতে পারেনি। প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে বাঙালি নিধন শুরু করে। তারা হিন্দু এবং বাংলাভাষী মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। একজন বাঙালি হিসেবে এমনি ভাবেই শহীদ নফিজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই তিনি রানীশংকৈল উপজেলায় স্বাধীনতার স্বপক্ষে মত গঠন শুরু করেন।এলাকায় মুত্তিযুদ্ধের নিবেদিত সংগঠক হিসেবে আলোচনায় ঝড় তোলেন শহীদ নফিজউদ্দিন আহমেদ। ১৯৭১ এ রাতদিন স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন শহীদ নফিজউদ্দিন আহমেদ, সংগঠিত করেন এলাকার যুবক ও তরুনদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য। হঠাৎ এর মাঝেই জীবনে ঘনিয়ে এলো শহীদ হওয়ার বার্তা! রাণীশংকৈলের সংস্কৃতিচর্চার স্বর্নমুকুট শহীদ নফিজউদ্দিন সেদিন দলীয় কাজ ও তার প্রিয় প্রতিষ্ঠিত প্রগতি ক্লাবের আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরে আসেন আর সেদিন রাতেই আনুমানিক ভোর ৩ টার দিকে তাকে পাকসেনারা নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে কালোকাপড় চোঁখে বেঁধে টেনে হিচরে নিয়ে যায়।

বড় মেয়ে লিলি সেদিন প্রিয় বাবার(নফিজউদ্দিন) পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক আটকের দৃশ্য অবলোকন করেন পাথর হয়ে যান। মেয়ে হিসেবে সেদিনের পাকসেনাদের হাতে পায়ে ধরে আকুতি করেও বাবাকে রক্ষা করতে পারেননি। প্রথমে চোঁখে কালোকাপড়ে বেঁধে পীরগঞ্জ থানায় আটকে রাখে । পরে তৎকালীন পাকিস্তানী দারোগা আঃ রশিদ বাড়িতে এই খবর দেন যে, ১২ মে, ১৯৭১ দিনাজপুরের কাঞ্চন নদীতে শহীদ নফিজ উদ্দিনকে হত্যা করে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে! পানির ¯্রােতে ভাষিয়ে দেওয়া মাষ্টারকে দাফন দিতে পারেনি তার পরিবার। সেদিনের স্মৃতি পরিবারের লোকদের মাঝে আজো বুকে রক্ত ঝরিয়ে চলছে।১৯৩৫ সালের ১০ আগস্ট সেদিনের দিনাজপুর জেলার রানীশংকৈল থানার সহোদর গ্রামে তার জন্ম। শহীদ নফিজউদ্দিনের দুই মেয়ে এক ছেলে। এই বছর তিনি কামারপাড়া পি,আর ইন্সটিটিউশন গাইবান্ধা হতে এস,এস,সি পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে এস,এন কলেজ দিনাজপুর হতে এইচ,এস,সি এবং একই কলেজ হতে ১৯৬৫ সালে বি,এ (পাশ) করেন। তিনি সুনামধণ্য বিদ্যাপীঠ ‘রানিশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়’এ শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রিয় শিক্ষকের পাকসেনাদের দ্বারা আটকের খবর পেয়ে সেদিনের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকসহ রানীশংকৈলের সাধারন মানুষ নীরবে চোঁখের পানি ফেলেছিলেন । আজ স্বাধীনতার প্রায় দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে দেশ অনেক এগিয়ে ।

শুধুকালো কুয়াঁশার চাঁদরে ঢেকে আছে শহীদ নফিজউদ্দিনের নাম। যদিও বর্তমানে ভিটে মাটিতে ছোট্র একটি টিনের ঘর। স্ত্রী ঝরনা বেঁচে নেই। মেয়েদের সংসার নিয়ে থাকা আর একমাত্র ছেলে পুলিশ অফিসার হয়ে চাকুরি সুবাদে কর্মস্থলে রয়েছে।নফিজজুদ্দিন আহমেদ একাধারে তিনি ছিলেন শিক্ষা অনুরাগী, সামাজ মনস্ক ও সচেতন একজন মানুষ। ষাট দশকেই তিনি রানিশংকৈল এ প্রগতি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন এবং রানিশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পুনঃ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। আজ রানীশংকৈলে শহীদ নফিজউদ্দিন নামটি প্রায় নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত। যে লোকটি নিজের জীবনকে লাল সবুজের পতাকায় উৎসর্গ করে পরিবারের জন্য শুধু মাত্র নিজ ভিটেতে একটি টিনের চালাঘর রেখেছেন ।

তিনি বাঙ্গালীর স্বাধীন হবার স¦প্ন দেখেছেন সেই তিনি আর কেউ নন ! স্বাধীনতার যুদ্ধে নিভৃতে চলে যাওয়া আমাদের সকলের শহীদ নফিজউদ্দিন স্যার! যাকে চিনতে হলে ৭১ এর কথা জানতে ভাবতে হয়। এই তো সেদিন বড় মেয়ে লিলি চোঁখের কোনে শাড়ীর আঁচল রেখে অভিযোগের ভাষায় বলেন , বর্তমানে প্রায় প্রভাবশালী নেতারাই শহীদ নফিজউদ্দিন নামটি কৌশলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন!

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি সফিকুল ইসলাম শিল্পী।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.