দাম নেই-বেশী চামড়ায় নষ্ট ও নদী গর্ভে : চাঁপাইনবাবগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ীরা দিশেহারা, স্বর্বস্ব হারিয়ে পথে


চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: গত কয়েকবছর ধরে চামড়ার দাম না পেয়ে এবং বিভিন্ন ট্যানারিতে পূঁজি পড়ে থাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ীরা অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। ব্যবসার অর্থ হারিয়ে দিশেহারা দীর্ঘদিনের মৌসুমী ও বছরব্যাপী চামড়া ব্যবসায়ীরা।

জীবিকার তাগিদে অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে চামড়া ব্যবসা না করতে পেরে অন্যের চামড়ার আড়তে শ্রমিকের কাজ করছেন। এবছর চামড়ার দাম সরকার নির্ধারন করে দিলেও সে মূল্যে নাটোরে চামড়া বিক্রি করতে না পারার অভিযোগ উঠেছে। আর করোনা এবং ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহে এবছর অনেক চামড়া নষ্ট হয়েছে।

অনেক চামড়া নষ্ট হতে বসেছে। চামড়ার নূন্যতম দাম না পেয়ে আবার অনেকেই চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছেন। এই অবস্থায় একদিকে চামড়া ব্যবসায়ীরা যেমন পথে বসছে, অন্যদিকে দেশের দরিদ্র অসহায় মানুষরা বছরের এই অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে আবার চামড়ার তৈরী জিনিষপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া।

বিপরিতধর্মী এঘটনায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে সাধারণ মানুষ ও সচেতন মহলের মাঝে। জেলার চামড়া ব্যবসার আসল স্থান শিবগঞ্জ উপজেলার সত্রাজিতপুর সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার অন্তত ৫০ জন চামড়া ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে এ পেশায় রয়েছেন মাত্র ৪ জন। বাকিদের সবাই পূজি হারিয়ে অন্য ব্যবসা বেছে নিয়েছেন, আবার কেউ অন্যের আড়তের শ্রমিক হয়ে ব্যবসার উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।

এমনই এক ব্যাক্তি ৪০ বছরের পুরানো চামড়া ব্যবসায়ী নিবারন রবিদাস। তাঁর ব্যবসায়ীক জীবনে এক মৌসুমেই ১৩ লক্ষ টাকার চামড়া কেনাবেচা করেছেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তার ব্যবসায়ীক জীবনে সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়েছে ৯০ হাজার টাকা। ভালই চলছিল ব্যবসা। এরপর থেকেই তার পুজি ঢাকা ও নাটোরের ট্যানারী ও মোকামগুলোতে আটকে যেতে থাকে।

বর্তমানে তার ৬ লক্ষ টাকা আটকে গেছে। ৩ বছরে ১০ লাখ টাকার লোকসানের কারনে তিনি এখন নি:স্ব। তাই সংসার চালাতে এবং হারানো পুজি উদ্ধার করতে কাজ করছেন তার ব্যবসায়ীক বন্ধু জেমের চামড়ার আড়তে শ্রমিক হিসেবে।

নিবারন রবিদাস বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, অনিল রবি দাশ, তৌফিক সহ আরও ৬ জন ব্যবসায়ী তার মত লেবারের কাজে জড়িত। তারাও তার মত স্বপ্ন দেখছেন শ্রমিকের কাজের পাশাপাশি আটকে পড়া টাকা তোলার।

অপর চামড়া ক্রেতা ব্যবসায়ী রাজিব রাজু বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, তিনি ও তার বন্ধু গতবছর লোকসানের কারনে এবছর করোনার মত পরিস্থিতিতে চামড়া কিনতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু স্থানীয়দের চাপে পরে দাম পরিশোধের শর্তসাপেক্ষে কিছু চামড়া কিনেছেন। পরিবহন সমস্যা হওয়ায় বেশ কিছু চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও বাকি চামড়া নাটোরে পাঠানোর পর এর মূল্য পাওয়া নিয়ে রয়েছেন নানা আশংকা।

বড় চামড়া ব্যবসায়ী জেম চামড়া আড়তের মালিক জেম বিশ্বাস দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, অধিকাংশরায় চামড়া না কেনায় তিনি এবছর গরু সর্বোচ্চ ৩শ টাকা দরে ২হাজার ৬’শ পিস এবং খাসি ৩৫ টাকা দরে ১২ হাজার পিস কিনেও অনেকটায় আতংকে আছেন। তিনি আরও জানান, দিনদিন চামড়া রক্ষনাবেক্ষন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মোকাম গুলোতে টাকা পড়ে থাকছে।

পাশাপাশি সরকারের বেধে দেয়া রেটে ট্যানারীগুলো চামড়া না কেনায় জেলার সকল চামড়া ব্যবসায়ীরায় বিপাকে পড়েছেন।
এদিকে জেলার সদর, শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুরে অনেক ব্যক্তি ও মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়ার মূল্য না পেয়ে এবং কোন ক্রেতা না পেয়ে কেউ মাটিতে পুঁতে ফেলেছে আবার অনেকে নদীতে ফেলে দিয়েছেন।

গত রবিবার বিকেলে কয়েকজন মৌসুমী ব্যবসায়ীকে গরু-ছাগলের চামড়া রহনপুর পূণর্ভবায় ফেলে দিতে দেখা গেছে। আড়তগুলোতে সেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ক্ষোভে তারা চামড়া নদীতে ফেলে দেয়।

গোমস্তাপুরের বোয়ালিয়া গ্রামের সামিউল বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, তার বাড়ির গরু সহ ৩টি পশুর চামড়া ঈদের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়িতে রেখেও কোন ক্রেতা না পেয়ে পূর্নভবা নদীতে ফেলে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে রহনপুর শিল্প ও বনিক সমিতি সভাপতি ফারুক হোসেন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে চামড়া কিনেছেন। ক্রয়কৃত চামড়া আড়তে বিক্রি করতে না পেরে সেই চামড়া নদীতে ফেলে দিতে হয়েছে।

শিবগঞ্জের কাপড় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলী রিপন বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, চামড়া বিক্রি করতে না পেরে সোমবার সকালে তার ও তার প্রতিবেশীর ৭টি চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।

এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মঞ্জুর হোসেন ক্ষোভের সাথে বিটিসি নিউজ এর প্রতিবেদককে জানান, গত ৬ বছরে নাটোর ও ঢাকার ট্যানারীগুলোতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ীদের চামড়া বিক্রি বাবদ পাওনা প্রায় ২ কোটি টাকা। এরা সিন্ডিকেট করে তাদের ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রেখে তাদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করছে। প্রতিবছরই তাদের পাওনা টাকা কিস্তি আকারে দেয়ার আশ্বাস দিলেও টাকা না দেয়ায় জেলার সব মিলিয়ে ২ শতাধিক চামড়া ব্যবসায়ীর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। প্রায় দেড়শ ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। যারা ব্যবসা ধরে রেখেছে তারাও ধুকে ধুকে মরছে।

তাই জেলার চামড়া ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকারকে চামড়ার উপযুক্ত মূল্য নির্ধারন করে সে মূল্যে চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ের নিশ্চয়তার পাশাপাশি বিদেশে কাঁচা চামড়া রপ্তানীর মাধ্যমে চামড়ার মূল্য বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যথায় চামড়া ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে দিলে, কুরবানীর পশুর সকল চামড়া নষ্ট হবে ভবিষ্যতে। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধও জানান তিনি।

সংবাদ প্রেরক বিটিসি নিউজ এর চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো: আশরাফুল ইসলাম রঞ্জু। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.