পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দান করার আগে ভাবুন

বিটিসি নিউজ ডেস্ক:  ছোট্ট এক শিশু তার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক দরিদ্র লোকের কাছে গেলো। দরিদ্র লোকটির হাতে শিশুটি টাকাটা দিয়ে বাবার কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলো , আমি কতটুকু দান করবো?

খুবই সহজ একটি প্রশ্ন এবং অন্য কোন উদ্দেশ্য এর পেছনে নেই:

আমাদের দান করার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এর আগে আমাদের আরও পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।

#  কী দান করবেন?
শুধু বস্তু গত সম্পদের মধ্যেই আমাদের দানের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়নি। এর বাইরেও এমন অনেক কিছু আমাদের দান করার আছে , যা কখনো কখনো হয় বস্তুগত সম্পদেরও চেয়েও বেশি। আমাদের ভাই-বোনদের আর্থিক সহযোগিতার পাশা পাশি অধিক প্রয়োজন আমাদের ভালোবাসা , সহানুভূতি ও মানসিক সমর্থন।

আমরা হয়তো সবসময় সম্পদ দান করতে পারবো না বা তাদের প্রয়োজনকে পূরণ করতে পারবো না। কিন্তু আমাদের হাতে রয়েছে তাদের জন্য দোয়া করার। তাদেরকে সহানুভূতি জানানোর এবং দুই একটি সান্ত্বনা দায়ক কথার মাধ্যমে তাদের মনে প্রশান্তি আনার ক্ষমতা।

#  কেন দান করবেন ?
আপনি যদি আপনার উপর আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে দান করতে চান , তবে আপনার সেই দান হবে সর্বোত্তম। আবার যদি আপনি দান করেন সমাজের দরিদ্রদের প্রতি আপনার দায়িত্ব বোধ থেকে অথবা তাদের প্রতি আপনার আত্মীয়তার বন্ধন থেকে অথবা এটি একটি সৎ কাজ হিসেবে আল্লাহর কাছ থেকে পুরষ্কার লাভের আশায়।

তবে আপনার এই দান আপনার জন্য অর্থবহ ও কল্যাণকর হবে। কেননা এটি আপনার হৃদয় থেকে আন্তরিকতার সাথে হয়েছে।

কিন্তু যদি আপনার দান হয় শুধু লোক দেখানোর জন্য বা লোকের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য , তবে আপনার এই দান আপনার জন্য কোন উপকারই করবে না।

কুরআনে আল্লাহ বলেন :

وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا . إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا . إِنَّا نَخَافُ مِن رَّبِّنَا يَوْمًا عَبُوسًا قَمْطَرِيرًا

“তারা আল্লাহর ভালোবাসায় অভাব গ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতি দান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। আমরা আমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে এক ভীতিপ্রদ ভয়ংকর দিনের ভয় রাখি।” –(সূরা দাহর, আয়াত: ৮-১০

সুতরাং, দানের জন্য অবশ্যই আমাদের দানের উদ্দেশ্যকে বিবেচনা করতে হবে।

#  কীভাবে দান করবেন?
যখন আপনি কাউকে কিছু উপহার দেন। তখন কিভাবে দেন? আপনার নিজের আচরণ তখন কেমন হয়? আপনি কি তখন সম্মান ও ভদ্রতা বজায় রাখেন? আপনি কি তখন যাকে উপহার দিচ্ছেন, তার প্রতি আপনার বিনয়কে প্রকাশ করেন? আপনি কি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রদর্শন করেন? নাকি আপনি অবমাননাকর আচরণ করেন? আপনি কি আপনার উপহারের কথা বড়াই করে তার কাছে প্রকাশ করেন?

যখন আপনি কাউকে কিছু দান করবেন, আপনার উচিত তা ভদ্রতা ও বিনয়ের সাথে প্রদান করা। ঘৃণাপূর্ণ মন নিয়ে কখনোই কাউকে দান করবেন না। বলা যায় না, আল্লাহ কখন আপনার অবস্থা পরিবর্তন করে দেন।

কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:

قَوْلٌ مَّعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِّن صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَا أَذًى ۗ وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَلِيمٌ . يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُم بِالْمَنِّ وَالْأَذَىٰ كَالَّذِي يُنفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۖ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا ۖ لَّا يَقْدِرُونَ عَلَىٰ شَيْءٍ مِّمَّا كَسَبُوا ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ . وَمَثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَتَثْبِيتًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍ بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَآتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ فَإِن لَّمْ يُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

বিনম্র ভাবে উত্তম কথা বলে দেয়া এবং ক্ষমা প্রদর্শন করা ঐ দান হতে উত্তম, যার পরে কষ্ট দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা সম্পদ শালী, সহিঞ্চু। হে ঈমানদার গণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দানকে বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল।

অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো। অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ঐ বস্তুর কোন সওয়াব পায় না। যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্যে তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মত।

যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়। তবে হালকা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন।” (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৬৩-২৬৫)

#  কখন দান করবেন?
কাউকে যখন কিছু দান করবেন, তখন তা যেনো দানগ্রহীতা ব্যক্তির কাছে বৃহত্তর প্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। আপনি যদি তার গুরুতর প্রয়োজনে তার প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহ করে তাকে সাহায্য করেন, তবে সে ব্যক্তি আপনার দানকে মূল্য দেবে। আপনার সাহায্য ও উপকারকে সে কখনোই ভুলবে না।

এছাড়া আপনি যখন আপনার নিজের প্রয়োজন স্বত্ত্বেও অপরের প্রয়োজন পূরণের জন্য অগ্রসর হন, একখন্ড রুটি অপর একজন ক্ষুধার্ত ভাইয়ের সাথে ভাগাভাগি করে খান, তবেই আপনি যথার্থভাবে সফল হতে পারবেন।

হিজরতের পর মক্কা থেকে আসা নিঃস্ব মুহাজিরদের প্রতি মদীনায় বসবাস কারী আনসাররা যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন,

কুরআনে আল্লাহ তার প্রশংসা করে বলেন:

وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِن قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِّمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করে না এবং নিজেরা অভাব গ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।” –সূরা হাশর, আয়াত : ৯

#  কতটুকু দান করবেন?
আপনার সামান্য দানই হয়তো অনেক সময় অনেক মানুষের উপকার করতে পারে। আল্লাহ হয়তো একটি মাত্র মুদ্রায় যে বরকত দিতে পারেন, তার তুলনায় হয়তো পাহাড় পরিমান সম্পদও কাজে আসবে না। নিঃস্ব, অসহায় মানুষকে আপনি সর্বোত্তম যে সম্পদটি দিতে পারেন, তা হল আপনার অন্তরের ঔদার্য। একমাত্র উদার হৃদয়ই তা প্রদান করতে পারে।

কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:

مَّثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنبُلَةٍ مِّائَةُ حَبَّةٍ ۗ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَن يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

“যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।” –সূরা বাকারা, আয়াত : ২৬১

আপনি যখন কাউকে কিছু দান করেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আপনি একটি প্রতিদান পাওয়ার যোগ্য হয়ে যান। আপনি যদি সামান্য কিছুও দান করেন, তাহলেও এর প্রতিদানে আপনি বিপুল কিছু পাওয়ার যোগ্য হন। যাই আপনি দান করেন না কেন, সবকিছুর জন্যই সর্ব প্রথম আপনার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে এবং তার অনুগ্রহের কারণেই আজকে আপনি দান করতে পারছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।” (সূরা হাশর, আয়াত: ৯)

যখন আপনি কাউকে কোন কিছু দান করবেন, দান করা সেই সম্পদ সম্পর্কে দ্বিতীয় আর কোন চিন্তা করবেন না, কারো কাছে এটি বলে বেড়াবেন না এবং অবশ্যই দানগ্রহীতাকে আপনার অনু্গ্রহের কথা বলে তার মনকে ছোট করবেন না।

শুধু একটি উদ্দেশ্যেই আপনি আপনি প্রকাশ্যে দান করতে পারেন। যখন আপনার আন্তরিক লক্ষ্য থাকবে যে, আপনার দান দেখে অন্য একজন লোকও দান করতে উৎসাহী হবে।

দান সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের বিকাশ ঘটান। শুধু বস্তুগত সম্পদের মধ্যে আপনার দানকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবেন না, বরং তাতে একই সাথে বন্ধুত্ব, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা বজায় রাখুন।

মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।#

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.