থানায় এজাহার বা মামলা করার পদ্ধতি ও গুরুত্ব

মো: খায়রুল ইসলাম : আমরা সবাই জানি যে ফৌজদারি মামলা দুইভাবে করা যায়। কোর্টে ও থানায়। কোর্টে যে মামলা করা হয় সেটাকে C.R (Complaint Register) বা নালিশি মামলা বলা হয়। থানায় যে মামলা করা হয় তাকে G.R (General Register) মামলা বলা হয়।
আপনি যদি কারো বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে চান তাহলে আপনাকে এজাহার দায়ের মাধ্যমে মামলা করতে হবে। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে, জিডি (সাধারণ ডায়েরি) আর এজাহার এক বিষয়। কিন্তু বাস্তবে এ দুটি বিষয় এক নয়। জিডি হচ্ছে থানায় কোনো ঘটনা সম্পর্কে অফিসারকে অবগত করা মাত্র, আর এজাহার হচ্ছে সরাসরি মামলা গ্রহণে পদক্ষেপ নেওয়া।
এজাহারে উল্লিখিত অপরাধ যদি আমলযোগ্য কিংবা এমন কোনো ঘটনা সংক্রান্ত হয়, যা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিলে আসামিদের ধরা যাবে বা শনাক্ত করা যাবে, সে ক্ষেত্রে পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেবে। আর যদি এজাহারে বর্ণিত অপরাধ বা বিষয়টি আমলযোগ্য না হয়, তবে পুলিশ এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করবে। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অনুমতি নেবে। এমনও হতে পারে, এজাহারকারীকে সরাসরি মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দাখিল করার পরামর্শ দেবে। জিডি করা হয় অপরাধ সংঘটনের আশংকা থেকে,অপরদিকে এজাহার করতে হয় অপরাধ সংঘটনের পরপর।
এজাহার কেবলমাত্র আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেই দায়ের করা যায়,কিন্তু জিডি যেকোন অপরাধ এমনকি কোন কিছু হারিয়ে গেলেও করা যায়।ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কত দিনের মধ্যে পুলিশকে সংবাদ দিতে হবে বা এজাহার করতে হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় আইনে দেওয়া নেই। তবে এজাহার করতে দেরি করা উচিত না।দেরিতে এজাহার মামলার গুণাগুণ নষ্ট করতে পারে বা আশংকা থাকে।
কোনো কারণে এজাহার করতে যদি দেরি হয় তবে তার সুনির্দিষ্ট কারণ এজাহারে উল্লেখ করতে হয়। এজাহারের আবেদন থানার অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) বরাবর লিখতে হবে। যেকোন ব্যক্তিই অপরাধ সংঘটন স্থলের নিকটবর্তী থানায় এজাহার রুজু করতে পারেন। তবে কোন কারণে থানা এজাহার নিতে না চাইলে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে নালিশি (Complaint Register) মামলা রুজু করা যায়।
ফৌজদারী মামলার বিচারে এজাহার অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।ঠিকমতো এজাহার দায়ের করতে না পারায় প্রতিনিয়ত অনেকেই বিচার পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিচারকালে এজাহারে কোন ত্রুটি ধরা পড়লে তা আর সাধারণত সংশোধন করা যায় না।এজাহারের ওপর যেকোনো  মামলার ভাগ্য অনেকটা নির্ভর করে। একটি শক্তিশালী এবং শুদ্ধ এজাহার একদিকে যেমন আইনের শত ব্যাখ্যার মধ্যেও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে অন্যদিকে ঠিক তেমনি দুর্বল ও অসঙ্গতিপূর্ণ এজাহার মামলার গুনগত মান নষ্ট করে বিচার বিলম্বিত করে আসামীদের জন্য বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করতে পারে। তাই বাদী হিসাবে এজাহার দায়ের করার পূর্বে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।
এজাহার কী?
এক কথায় সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কিত অভিযোগ করাকে এজাহার বলে। অপরাধী ও সংঘটিত আমলযোগ্য অপরাধের বিস্তারিত বিবরণসহ শাস্তি দাবী করে বা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে থানায় অপরাধের সংবাদ লিপিবদ্ধ করাকে এজাহার বলে। যা FIR (First Information Report) বা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী নামেও পরিচিত। অপরাধ সম্বন্ধে এ বিবরণ প্রথম দেয়া হয় বলে একে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বলে। আমলযোগ্য অপরাধ (Cognizable offence) হচ্ছে সেই অপরাধ যে অপরাধের দরুণ অভিযুক্তকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়।
এজাহার লিখিত বা মৌখিক দুভাবেই করা যেতে যায়। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় এজাহার সম্পর্কে বলা হয়েছে – কোন থানার অফিস-ইন-চার্জ-এর (OC) নিকট কোন আমলযোগ্য অপরাধ সংঘঠিত হওয়া সম্পর্কে কোন সংবাদ মৌখিকভাবে প্রদান করা হলে তিনি বা তার নির্দেশক্রমে অন্য কেউ সাথে সাথে তা লিখে তথ্য প্রদানকারীকে পড়ে শুনাবেন এবং তথ্য প্রদানকারীর স্বাক্ষর নিবেন। লিখিতভাবে প্রদত্ত সংবাদের ক্ষেত্রেও তথ্য প্রদানকারী স্বাক্ষর করবেন। এই তথ্য বিবরণী উক্ত অফিসার সরকার কর্তৃক নির্দেশিত (বিপি ২৭) ফরমে লিপিবদ্ধ করবেন। তবে অপরাধের সংবাদটি বিস্তারিত না হলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনী ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্ত করতে পারবে।
এজাহার কে করতে পারেন?
কোথাও কোন ফৌজদারি অপরাধ যেমন খুন, মারামারি, ডাকাতি, চুরি ইত্যাদি সংঘঠিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে যে কেউ থানায় সংবাদ দিতে পারে। অপরাধ সংগঠিত হলে থানায় সাদা কাগজে একটি লিখিত অভিযোগ (এজাহার) দাখিল করতে হয়।ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে বা তাঁর পরিবারের কেউ কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি, যিনি ঘটনা ঘটতে দেখেছেন কিংবা ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন, তিনি থানায় এজাহার করতে পারেন। মূলত এজাহার করার মাধ্যমে থানায় মামলা করা হয়। এজাহারটি থানার অফিসার ইনচার্জ-এর নিকট জমা দিতে হবে। এজাহার দাখিলের পর থানার অফিসার -ইন-চার্জ FIR (First Information Report) (একটি নির্দিষ্ট ফরম) এনট্রি করার ব্যবস্থা করবেন এবং একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন। এজাহার প্রাপ্তির ২৪ ঘনটার মধ্যে FIR (First Information Report) ফরম পুরন করে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দাখিল করবেন। যাকে আমলী আদালত বলে। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত শুরু করবেন। মামলা করতে থানায় কোনো ফি দিতে হয় না।
মামলার এজাহারে যেসব বিষয় উল্লেখ করা জরুরি: 
সঠিকভাবে এজাহার করতে না পারায় অনেকেই বাধ্য হয়ে অর্থের বিনিময়ে দালালের সাহায্য নিয়ে থাকে। এতে দেখা যায়,ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী না হওয়ায় এজাহারে এ সকল দালালেরা ঘটনার প্রকৃত বিবরণ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়।যার কারণে এজাহার দুর্বল হয়ে যায় এবং আসামির বিপক্ষে মামলা প্রমান করা কঠিন হয়ে পড়ে।ফৌজদারী মামলার ভিত্তিই হচ্ছে এজাহার,তাই এজাহারে অপরাধী ও অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সতর্কতার সঙ্গে তুলে জরুরি।
এজাহারে কোন ঘষা-মাজা,কাটা-কাটি বা লেখা অস্পষ্ট করা যাবে না। এজাহার লিখিত হলে সাদা কাগজের এক পিঠে লিখতে হবে। কম্পোজ করেও দেওয়া যায়।এজাহারে (১) স্পষ্টভাবে অপরাধীর নাম ও ঠিকানা (জানা থাকলে) উল্লেখ করা;(২) ঘটনার পূর্ণ বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা যৌক্তিকভাবে লিপিবদ্ধ করা;কীভাবে ঘটনা ঘটল তার বিবরণ স্পষ্টভাবে লিখতে হবে।(৩)অপরাধ সংঘ্টনের তারিখ ও সময় উল্লেখ করা;(৪) অপরাধ সংগঠনের স্থান উল্লেখ করা;(৫) অপরাধ সংঘটনের কোন পূর্ব সূত্র বা কারণ থেকে থাকলে তার বর্ণনা তুলে ধরা;(৬) অপরিচিত ও সন্ধিগ্ধ ব্যক্তিদের সম্পর্কে ধারণা দেয়া;(৭) অপরাধ পরবর্তী অবস্থা যেমন -সাক্ষীদের আগমন, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা;(৮) সাক্ষীদের নাম,ঠিকানা ইত্যাদি উল্লেখ করা;(৯) অপরাধীদের কেউ বাধা দিয়ে থাকলে তার ধারাবাহিক বর্ণনা করা;(১০)অপরাধীদের কেউ এজাহার দায়েরে বাধা দিয়ে থাকলে তার ধারাবাহিক বর্ণনা;(১১)কোন বিষয় তাৎক্ষনিকভাবে লেখা সম্ভব না হলে পরবর্তীতে সে বিষয়টি সংযোজন করা হবে এমন একটি কৈফিয়ত রাখা প্রভৃতি বিষয়াবলী উল্লেখ করা জরুরি।(১২)এজাহারকারীর পূর্ণ ঠিকানা ও সই থাকতে হবে।(১৩)বাদী কোন কারণে থানা সরাসরি না যেতে পারলে কার মাধ্যমে এজাহার থানায় পাঠানো হলো তার নাম ঠিকানা ও থানা না যেতে পারর কারণে উল্লেখ করতে হবে। (১৪)লিখিত এজাহার লেখকের নাম ঠিকানা এজাহারের উল্লেখ করতে হবে।(১৫)চোরাই যাওয়া মালের তালিকা শনাক্তকরন সহ উল্লেখ করা।(১৬)এজাহার দাখিলে বিলম্ব হলে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা (অযৌক্তিক বিলম্ব মামলার গুণগত মান নষ্ট করে)।
যদিও ফৌজদারী অপরাধের কোন তামাদি(নির্দিষ্ট সময়) নেই,তথাপি এজাহার দায়েরে বিলম্ব মামলার গুনগতমান বিনষ্ট করে থাকে। লিখিত এজাহারের বেলায় সংঘটিত অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ স্বাক্ষরসহ দরখাস্ত আকারে সংশ্লিষ্ট থানায় দাখিল করতে হয়। প্রাপ্ত দরখাস্তের তথ্যাদি থানার অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) এজাহারের জন্য নির্ধারিত বিপি ২৭ ফরমে তুলে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেন।যদি মৌখিকভাবে থানায় এজাহার দেওয়া হয়,তাহলে থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তা লিখবেন। ঘটনার বিবরণ তিনি তথ্য প্রদানকারীকে পড়ে শুনিয়ে আপত্তি না থাকলে তাতে তার স্বাক্ষর নিবেন।আর যদি তথ্য প্রদানকারী কোন সংশোধন আনতে চান তবে তা আনার পর স্বাক্ষর নিবেন।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো এজাহারকারী যদি মৌখিক কোনো বিবৃতি দেন, তাহলে তা লিখিত আকারে নিয়ে এজাহারকারীকে পড়ে শোনাতে হবে এবং তাঁর স্বাক্ষর নিতে হবে। যে কর্মকর্তা এজাহার লিখবেন, তিনিই সিল ও সই দেবেন। কোনো আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনা থানায় এলে তা মৌখিক আর লিখিত—যা-ই হোক, এজাহার হিসেবে নিতে থানা বাধ্য থাকবে। কোনো ঘটনার সংবাদ টেলিফোনে বা ই-মেইলে মাধ্যমে থানায় এজাহার দায়ের করা যাবে না। ফৌজদারী মামলার বিচারে এজাহার অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
তাই বিচারকালে এজাহারে কোন ত্রুটি ধরা পড়লে তা আর সাধারণত সংশোধন করা যায়না। এজাহারের ওপর মামলার ভাগ্য অনেকখানি নির্ভর করে।একটি শক্তিশালী এবং শুদ্ধ এজাহার একদিকে যেমন আইনের শত ব্যাখ্যার মধ্যেও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে অন্যদিকে ঠিক তেমনি দুর্বল ও অসঙ্গতিপূর্ণ এজাহার মামলার গুনগত মান নষ্ট করে বিচার বিলম্বিত করে আসামীদের জন্য বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করতে পারে।
তাই এজাহার দায়ের করার পূর্বে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। ত্রুটিজনিত এজাহারের কারণে বিচার বঞ্চিত হয়ে চোখের জল ফেলতে হবে। একটি শক্তিশালী এবং নিরেট এজাহার লিখার জন্য একজন আইন বিজ্ঞ পুলিশ অফিসার কিংবা আইন বিজ্ঞ আইনজীবীর সহায়তা নেয়া শ্রেয়।
লেখক- মো: খায়রুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। #

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.